যদিও পড়াশোনার জন্য ঢাকা শহরে থাকি, গ্রামে গেলে গ্রামের বর্তমান আর্থসামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা নিয়ে বন্ধুদের সাথে কথা বলি। আমার জন্ম ১৯৯৮ সালে। যখন আমার জন্ম হয়, তখন বাংলাদেশ আজকের বাংলাদেশের মতো ছিল না। তখন দেশের সব এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না, বাড়িতে বাড়িতে টেলিভিশন ছিল না, হাতে হাতে মুঠোফোনও ছিল না। মানুষে মানুষে ছিল হৃদ্যতা, সখ্য। সবার মধ্যে ছিল অমায়িক বন্ধুত্ব যেটি ছিল অনেক শক্তিশালী। ছোট ছেলেমেয়েরা সন্ধ্যা হলে হাত–মুখ ধুয়ে পড়তে বসত। তখন সবাই পাল্লা দিয়ে বই পড়ত। কারও পড়ার আওয়াজ একটু কম হলেই মা–বাবা বলত, ‘অমুক ওই বাড়িতে পড়ছে, এখান থেকে শোনা যাচ্ছে। তোর পড়া শোনা যাচ্ছে না কেন? জোরে জোরে পড়।’ রাস্তায় বের হলেই প্রতিটি বাড়ি থেকে পড়ার আওয়াজ ভেসে আসত কানে। গ্রামের মায়েরা শিক্ষিত না হলেও সন্ধ্যার পর শিশুদের পাশে বসে থাকত। পড়ালেখা করাত। সকাল হলেই ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে স্কুলে যেত। বিকাল হলে সবাই মাঠে খেলতে যেত। তখন সিঁদুর টোকানো, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, গোল্লাছুট, লুডু, চোর–ডাকাত, লুকোচুরি, মার্বেল খেলা, ট্রাই খেলা খুবই জনপ্রিয় ছিল।
আমি এমন একটি পরিবার থেকে বেড়ে উঠেছি যে পরিবারের কেউই লেখাপড়া জানে না এমনকি স্বাক্ষরজ্ঞান পর্যন্ত নেই। তারপরও আমার বাবা, মা, ঠাকুরদা, ঠাকুরমা সব সময় চেষ্টা করেছে পাশে বসে থেকে পড়াতে। সন্ধ্যা হলেই বলত হাত–মুখ ধুয়ে বই নিয়ে বসতে, জোরে জোরে পড়তে। তাঁদের কথামতো সন্ধ্যা হলেই প্রতিদিন বই পড়তে বসতাম কুপি বা হারিকেনের আলোয়। আমার সাথে পাল্লা দিয়ে পড়ত সুফল, সুফলের সাথে পাল্লা দিয়ে পড়ত ওর পাশের বাড়ির অমিত। তিনজনের বাড়ি পাশাপাশি হওয়ায় এবং তিনজন সময়বয়সী হওয়ায় তিনজনের মধ্যে পড়ালেখা নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা সব সময় চলত। অমিত তো মাঝে মাঝে সারা রাত পড়ত।
সকাল হলেই স্কুলে যেতাম। বাড়িতে এসে বিকালে খেলতে যেতাম মাঠে। তখন গ্রামে মাঠ ছিল। মাঠে সবাই একসাথে খেলতাম। তা ছাড়া বন্ধুদের সাথে মার্বেল খেলতাম, সিগারেট ও দেশলাইয়ের প্যাকেট দিয়ে তাস খেলতাম, যেটা স্থানীয় ভাষায় ট্রাই নামে পরিচিত। এসব খেলা আমাদের হিসাব শিখতে অনেক সাহায্য করত। সাধারণ হিসাবগুলো অনেক দ্রুত মুখে মুখেই করে ফেলতে পারতাম।
২০০৪ সাল। তখন আমি অনেক ছোট, ব্র্যাক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। তখন আমাদের নড়াইল জেলার বিভিন্ন এলাকায় ব্র্যাক থেকে অনেকগুলা স্কুল পরিচালিত হতো। এসব স্কুল থেকে শিশুদের দেওয়া হতো সুন্দর সুন্দর গল্পের বই। প্রতিটি গল্পের বই ছিল রঙিন চিত্রসংবলিত। সে সময় বইগুলো পড়তে যে এত ভালো লাগত যে সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। গল্পগুলো পড়তাম আর নিজে নিজে গল্পের ছবি ও চরিত্রগুলো দিয়ে গল্পটাকে মনে মনে সিনেমার মতো করে ভাবতাম। চোখের সামনে ভাসত চরিত্রগুলো। শিশুদের এসব গল্পের বই মানসিক বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। ছোটবেলায় সেই সব গল্প পড়ে এত মজা লাগত যে মনে হতো, পৃথিবীর সব সুখ এই বই পড়ার মধ্যে। সে সময় ব্র্যাক স্কুল থেকে যত গল্পের বই আসত, সবগুলোই পড়ে শেষ করতাম। সাথে অন্যান্য বইও পড়তাম। তারপর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। সেখান থেকে পাস করে মাধ্যমিক শেষ করলাম। তখন পড়াশোনা আর খেলাধুলা ছাড়া কিছুই ছিল না।
আস্তে আস্তে এলাকায় বিদ্যুৎ এল, বাড়িতে বাড়িতে টেলিভিশন এল, হাতে হাতে ফোন এল। সবাই ধীরে ধীরে যন্ত্রে পরিণত হতে শুরু করল। এখন শিশুদের ঘুম ভাঙে মুঠোফোন হাতে নিয়ে আর ঘুমাতেও যায় মুঠোফোন হাতে নিয়ে। এখন আর সন্ধ্যার পর পড়ালেখার আওয়াজ ভেসে আসে না। সন্ধ্যা নামলেই মা–কাকিমারা রান্না শেষ করার জন্য তাড়াহুড়ো শুরু করে, কারণ টিভিতে সিরিয়াল চলছে। সিরিয়াল বাদ দেওয়া যাবে না। রান্না শেষ করেই তারা টেলিভিশন চালু করে বসে যায় সামনে। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই একই চিত্র দেখা যায়। একটি বাড়িতে যদি টেলিভিশন চলে, তাহলে সেই বাড়ির শিশুরা কীভাবে পড়ালেখায় মন বসাবে? তা ছাড়া শিশুদের সবার হাতে হাতে মুঠোফোন থাকায় সবাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেতে থাকে, রিলস দেখে, টিকটক দেখে, গেম খেলে। কেউ কেউ আবার ভার্চ্যুয়াল জুয়া খেলে। এই জুয়ার কারণে আমাদের দেশের শত শত পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের অভিভাবকেরা তাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদাসীন। তারা এখন খুব কমই ভাবে তাদের শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিয়ে। শিশু কথা বলা শেখার আগেই তাকে মুঠোফোনে আসক্ত করে ফেলে। সন্ধ্যার পর যে শিশুদের পাশে বসে থেকে তাদের পড়ালেখায় উদ্বুদ্ধ করতে সেটি তারা ভুলে গেছে। তারাও হয়তো মুঠোফোন নয়তো টিভির সিরিয়ালে আসক্ত। এই সুযোগে শিশুরা ছোট থেকেই বিগড়ে যায়। উঠতি বয়সী ছোট শিশু পড়ালেখা থেকে দূরে সরে যায়, ধীরে ধীরে নেশার সাথে জড়িয়ে পড়ে, গেমে, জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ে। এভাবেই তারা ধীরে ধীরে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে, ফুলগুলো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়।
আমি ২০১৫ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমাদের গ্রাম থেকে একসাথে ১৮ জন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। এখন ২০২৪ সালে মাত্র ৪ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। এটা থেকে বোঝা যায় বর্তমান প্রজন্ম পড়ালেখা থেকে কতটা দূরে সরে যাচ্ছে।
এই চিত্র শুধু আমার গ্রামের নয়, চিত্রটি পুরো দেশের।
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে ছোট ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এখন কাউকে ছোটখাটো কোনো হিসাব করতে দিলে বা অঙ্ক করতে দিলেই মুঠোফোন থেকে ক্যালকুলেটর বের করে। অথচ আমরা মার্বেল, ট্রাই আর ক্রিকেট খেলতে খেলতে শিখেছিলাম। এখন সবাই হয়ে পড়েছে গুগল আর চ্যাটজিপিটিনির্ভর। মানুষ মাথার মধ্যে তথ্য কম সংরক্ষণ করে এভাবেই শিশুদের মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে বোকা হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে আর বন্ধুদের একসাথে গল্প করতে দেখা যায় না, দল বেঁধে ঘুরতে যেতেও খুব কমই দেখা যায়। সবাই যার যার মতো বাড়িতে সারা দিন শুয়ে শুয়ে মুঠোফোন নিয়ে পড়ে থাকে।
আধুনিক প্রযুক্তি যে সব সময় ক্ষতি করছে, এমনটাও নয়। প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। পৃথিবীর সবকিছু এখন হাতের মুঠোয়। টেলিভিশন ও মুঠোফোন বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। দেশ-বিদেশের সংবাদ মুহূর্তেই আমরা জানতে পারি মুঠোফোন ও টেলিভিশনের মাধ্যমে। পৃথিবীর অপর প্রান্তে থাকা আত্মীয়স্বজনের সাথে সহজেই ভিডিও কলে কথা বলতে পারি, ছবি ও ভিডিও আদান–প্রদান করতে পারি, টাকা লেনদেন করতে পারি। এ ছাড়া ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ আসার কারণে বৈদ্যুতিক বাতি দিয়ে আমরা চাইলে স্বাচ্ছন্দ্যে পড়ালেখা করতে পারি।
সবার মাঝে এখনই সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তথ্যপ্রযুক্তির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে। পড়াশোনার জন্য গ্রামের সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অভিভাবকদের পড়ালেখার সুফল সম্পর্কে বোঝাতে হবে। আমি ভেবেছি, এবার শীতের ছুটিতে গ্রামে গিয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করব যেখানে আমার গ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ভাইবোনেরা বক্তা হিসেবে থাকবে এবং শ্রোতা হিসেবে থাকবে অভিভাবকেরা। এ জন্য প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েসহ অভিভাবকদের উপস্থিত থাকতে বলব। সবার মাঝে সচেতনতা ছড়িয়ে দেব। সবাইকে পড়ালেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করব, যাতে আমার গ্রামের মানুষের উন্নয়ন হয়।
আনন্দের রঙিন রাতগুলো : ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবল
একটি ছোট্ট গ্রাম ভারতের ইউটিউব রাজধানী হয়ে উঠেছে
প্রযুক্তির উন্নয়নে গ্রাম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পড়ালেখা
শাড়ি নিয়ে শিল্পীতে-অনুরাগীতে আলাপ
ক্রিস্টোফার ম্যাকক্যান্ডলেস: নিঃশব্দে প্রকৃতির পথে
জীবন থেমে থাকে না, বরং অন্যভাবে গল্প শুরু হয়
মনে হচ্ছিল আমার কোনো অঙ্গহানি হয়ে গিয়েছে
বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষন কথা বললাম
কক্সবাজার ডিভাইন রোডের পউষী রেস্টুরেন্টে মোহাম্মদ ওমর ফারুক ও মহি উদ্দিন
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছিল