জীবনজয়ীর আহবানে সাড়া দিলে স্বেচ্ছায় পুরো ২৪ ঘণ্টা নেটহীন থেকে নাই নেট নিয়ে লিখতে হয়। আমার ফোন হারিয়ে যাওয়ার পর প্রায় তিন দিন নেটহীন থাকতে হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে আমার অভিজ্ঞতাগুলো জীবনজয়ীর পাঠকদের জন্য লেখা উচিত। আমরা সবাই মোটামুটি মোবাইল ফোননির্ভর। হুট করে ফোনটা হারিয়ে গেলে কেমন অনুভূতি হয়! এই লেখা থেকে তার ধারণা নেওয়া যাবে। ইচ্ছে করলে আমি আমার ল্যাপটপ দিয়েও নেট চালাতে পারতাম। পুরো দিন বাটন ফোন দিয়েই কাজ চালিয়েছি। জেনুইন অভিজ্ঞতা লেখার জন্য।
১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫। একটা রিসার্চ প্রজেক্টে ডাটা কালেকশনে যাচ্ছি। রামপুরা ব্রিজ পার হয়ে আফতাব নগরে ঢুকলাম। বেশ গুছানো ছোট উপশহর। আমাদের গন্তব্য ছিল দাসেরকান্দি। রাস্তা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। রিকশা ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি যাবে না। আমরা পাঁচজনের টিম। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিলাম। রিকশাটি আধাপাকা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। আশেপাশের পরিবেশটা বেশ সুন্দর। রাস্তায় পড়ে থাকা ভাঙা ইটের কারণে ঝাঁকুনি হচ্ছে প্রচুর। আমার শখের ফোনটা পকেটেই রেখেছিলাম। মাঝেমধ্যে রাস্তার দুপাশে অপরূপ দৃশ্য দেখে ছবি তোলার জন্য মন চঞ্চল হয়ে যাচ্ছিল। বন্ধুকে নিয়ে ঢাকা ওয়াসার মূল ফ্যাক্টরির সামনে কয়েকটা ছবি তুললাম। ছবি তোলার পর আবার রিকশায় চড়ে গন্তব্যের দিকে যাচ্ছি।
এ সময় একবার ফোনটা পকেট থেকে রিকশায় পড়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখছিলাম। আবার রিকশায় চড়ে দাসেরকান্দির দিকে যাচ্ছি। বন্ধুর সাথে অপরূপ দৃশ্য দেখছি। যতই দেখি ভালো লাগে। ঢাকার মূল শহর থেকে দূরে গেলে বাতাসে অক্সিজেন লেভেল বাড়ে মনে হলো। বুক ভরে নিশ্বাস নিচ্ছিলাম। প্রকৃতির খুব কাছাকাছি চলে যাওয়ায় হুমায়ূন আহমেদের কালজয়ী চরিত্র হিমুর মতো লাগছিল। বাউন্ডুলে অনুভূতি। রিকশা চলছে তো চলছেই।
ঝাঁকুনি কাকে বলে। এই ঝাঁকুনির কারণে পকেট থেকে ফোনটা অটোরিকশার সিটে পড়ে গেল! খেয়াল করিনি। রিকশাটি আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আমি পকেটে হাত দিলাম। কী যেন একটা কম লাগছে। বুঝে উঠতে পারছি না। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার ফোনটা পকেটে নেই। বিস্ময়ে থ হয়ে রইলাম। নিমিষেই মনে হলো আমি পুরো পৃথিবী থেকে লগ আউট হয়ে গেছি। আম্মুর নাম্বার ছাড়া আর কারো নাম্বার মনে নেই। কখনো মুখস্থ করার প্রয়োজন মনে হয়নি। আমার ফোনও হারিয়ে যেতে পারে তা কখনো চিন্তায়ও আসেনি। বন্ধুর ফোনটা নিয়ে আমার নাম্বারে কল দিলাম। রিং হচ্ছিল। কেউ ধরছিল না। তারপর আবার কল দিলাম। বন্ধ দেখাচ্ছে।
আম্মুকে কল দিয়ে ব্যাপারটা জানালাম। আম্মু টেনশনে পড়ে গেলেন। আমি ফোন হারিয়ে ফেলায় কষ্ট পাইনি। আমার কষ্ট হচ্ছিল পুরো ৬ বছরের ক্যাম্পাস লাইফের সব ছবি হাতছাড়া হয়ে গেল। কত আনন্দঘন মুহূর্ত ছবি আকারে সংরক্ষিত ছিল। প্রাথমিক শোক কাটিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। বন্ধু কেডিকে বললাম ফেসবুকে একটা পোস্ট দিতে। ইমরানের ফোন হারিয়ে গেছে বলে। কারণ আমার ফোনটা দিয়ে কেউ অঘটন ঘটালে সব দোষ আমার ওপরই এসে পড়বে। তারপর আমার আরেক ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম। কীভাবে কী করা যায়! থানায় জিডি করলাম। জানি ফোনটা পাব না। তারপরও কোনো অসুবিধা যাতে না হয়। দুঃখের বিষয় হলো আমি ফোনের আইএমআই নাম্বার সংরক্ষণ করে রাখিনি। পুলিশ কেস নিচ্ছিল না। তারপরও একটু বুঝিয়ে বললাম। ফোন নাম্বার আর ভোটার কার্ড দিয়ে একটা জিডি করলাম।
দাসেরকান্দি দারুসসুন্নাহ মাদ্রাসায় ডাটা কালেকশন বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল। মাদ্রাসার ছাত্রদের থেকে ছোট ছোট প্রশ্নের সহজ উত্তর পাওয়ার চেষ্টা। গড়পড়তা আইকিউ খুব একটা ভালো না। এই কাজে ছিলাম প্রায় ৫-৬ ঘণ্টা। প্রতিনিয়ত মোবাইলটার কথা মনে পড়ছিল। সময় দেখতে পারছিলাম না। নিমিষেই সবার সাথে ডিসকানেকটেড হওয়ার অনুভূতি খুবই পেইনফুল। আম্মুর নাম্বার ছাড়া কারো নাম্বার জানি না। ফেসবুকে ঢুকতে পারছি না। ইউটিউব দেখতে পারছি না। মনে হচ্ছিল আদিম যুগে বসবাস করছি। মাথাটা বনবন করছিল। ড্রাগ অ্যাডিক্টদের কাছ থেকে হঠাৎ ড্রাগ ছিনিয়ে নিলে যেমন অনুভূতি হয় তেমনটাই ফিল হচ্ছিল। অদ্ভুত এক অনুভূতি। লিখে বোঝানো যাবে না। হঠাৎ ফোন হারিয়ে ফেললে এরকম অনুভূতি পাওয়া যাবে।
দাসেরকান্দিতে কাজটা শেষ করে হলে ফিরছিলাম। গুগল ম্যাপ ছাড়া মনে হচ্ছিল অন্ধের মতো ছুটে চলছি। ঢাকার পথঘাট সব গোলমেলে লাগছিল। লোকাল বাসগুলোতে এমনিতেই চলাচল কঠিন কাজ। ঢাকার স্থানীয় লোকগুলোও ঠিকঠাক মতো রাস্তা বলে দিতে পারেন না। একরকম অন্ধের মতো রাস্তার মানুষদের জিজ্ঞেস করে করে হলে এসে পৌঁছলাম। মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া পথিকের মতো হলপাড়ায় হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম। কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। বন্ধুদের কল দিতে পারছি না।। কারো নাম্বারই মনে নেই। কারো কাছ থেকে ফোন নিয়ে যে কল দেব তারও সুযোগ নেই। আমার মনে অসম্ভব ঝড় বয়ে যাচ্ছে। খুব কষ্ট লাগছিল। কখনো কিছু হারিয়ে গেলে সেটা বারবার মনে পড়তেই থাকে। মাথায় পেইন হচ্ছিল।
প্রথম কাজ হিসেবে তাড়াতাড়ি আমার সিম দুটো তুলে আনলাম। তারপর ইস্টার্ন মল্লিকাতে গিয়ে একটা সুন্দর দেখে বাটন ফোন কিনলাম। ফোনটা দেখতে সুন্দর কিন্তু নেট চালানোর সুবিধা নেই। হঠাৎ করে বাটন ফোনে অভ্যস্ত হতে পারছিলাম না। পরের দিন সকালে ওঠার জন্য আগের ফোনে সহজেই অ্যালার্ম সেট করতে পারতাম। এই ফোনে পারছিলাম না। রাতে ফেসবুকে আপডেট দেখতে পাচ্ছি না। কখন কী হচ্ছে। প্রতিদিন রাতে কয়েক ঘণ্টা ইউটিউব ডকুমেন্টারি দেখার অভ্যাস! কিন্তু ফোন না থাকায় অসহ্য লাগছিল। ঘুম আসছিল না। রাতের এই টাইমে ফোন স্ক্রলিং করার ক্র্যাভিং কাজ করছিল। খুবই পেইনফুল। মগজে অস্থিরতা।
শুনেছিলাম, হঠাৎ অভ্যস্ত কোনো কাজে বাধা আসলে শরীর সে পরিবর্তন মানিয়ে নিতে পারে না। এটা প্রত্যক্ষ করলাম। আগে বিশ্বাস হতো না। ফোন হারিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হচ্ছে। ঘুম আসছে না। এপাশ ওপাশ করছি। মাথায় দুনিয়ার সব চিন্তা বনবন করছে।
এসব ছাইপাঁশ চিন্তা করতে করতে কখন ঘুম আসলো বুঝতে পারিনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছিল। নাশতা করে একটা বই নিয়ে পড়তে বসলাম। রুমের এক ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম কয়টা বাজে! কী কষ্টের বিষয়। সময় কয়টা বাজে তাও বুঝতে পারছি না। ফোন ছাড়া থাকা মানে পুরো পৃথিবী থেকে বহিষ্কার হয়ে যাওয়া। কোনো আপডেট, নিউজ, খোঁজখবর, কুশল বিনিময় কিছুই করা যায় না। জেলেবন্দি থাকলেও এরকম কষ্ট হতো বলে মনে হচ্ছে না।
উনি বললেন সাড়ে এগারোটা বাজে। পুরো ২৪ ঘণ্টা নেটহীন থাকার চ্যালেন্জ সম্পন্ন হলো! যদিও আমি ল্যাপটপে নেট চালাতে পারতাম কিন্তু জীবনজয়ীর জন্য এই চ্যালেঞ্জটা নিলাম। নিখুঁত অভিজ্ঞতাটা তুলে ধরার জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে যা পেয়েছি তা কোনোদিন ভুলব না
কীভাবে একটি ছোট্ট গ্রাম ভারতের একটি ইউটিউব রাজধানী হয়ে উঠেছে?
মানবিক রোবট : এক নতুন যুগের সূচনা
হেলথকেয়ারে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স : ভবিষ্যতের আশার আলো
টইটই করে দিনরাত এক করে ঘুরে বেড়িয়েছি
জীবন থেমে থাকে না, বরং অন্যভাবে গল্প শুরু হয়
মনে হচ্ছিল আমার কোনো অঙ্গহানি হয়ে গিয়েছে
বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষন কথা বললাম
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছিল
দিনটায় আমি নিজেকে সময় দিতে পেরেছি
আপনি কোন সাহিত্যিকের কবিতা বা রচনা রোমান্টিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত মনে করেন?