বর্তমানে দেখা যাচ্ছে যে ছোট ছোট গ্রাম ইউটিউবকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে নিজেদের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন সাধন করছে। যেমন—গ্রামের জীবনযাত্রা, কৃষি, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প, আদিম প্রচলিত প্রথা ইত্যাদি ভিডিও করে বিভিন্ন সামাজিক প্ল্যাটফর্ম যেমন ইউটিউব, ফেসবুক ও টিকটকে শেয়ার করছে। এতে দেখা যাচ্ছে যে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ভিডিওগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, দেশ বিদেশের মানুষজন ভিডিও দেখছে লাইক ও কমেন্ট করছে—এভাবেই মানুষজন অনুপ্রাণিত হচ্ছে, নতুন নতুন ভিডিও তৈরি করছে। এর ফলে ক্রমান্বয়ে গ্রামের মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে, বেকারত্ব হ্রাস পাচ্ছে, আয় বাড়ছে এবং সামাজিক ভাবে তারা আরো এগিয়ে যাচ্ছে। 

এখন আমরা দেখব কীভাবে ভারতের একটি ছোট গ্রাম, তুলশী, মধ্য ভারতের রায়পুরের বাইরে অবস্থিত, ইউটিউব ক্যাপিটাল গড়ে তুলল। বিবিসি নিউজের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, জয় ভার্মা নামক একজন ৩২ বছর বয়সী ভদ্রলোক গ্রামীণ মহিলাদের নিয়ে ভিডিও করে তার নতুন ব্লগ তৈরি করছে। এক বৃদ্ধ মহিলা শাড়ি পরে চেয়ারে বসে আছেন, অন্য একজন মহিলা তাকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিচ্ছে, এরকম ভিডিও তৈরি করতে মহিলারাও বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন, গ্রামীণ এসব কনটেন্ট দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে মুহূর্তের মধ্যে ই ছড়িয়ে পড়ছে। 

এর কিছু মাইল দূরে, অন্য এক দল ইউটিবার তাদের নিজস্ব ভিডিও যেমন একজন ২৬ বছর বয়সী যুবক চলন্ত বাসের পিছন দৌড়ে প্রচলিত মুভির হিরোর মতো অভিনয় করে ভিডিও তৈরি করছে। কেউ কেউ ভিডিও এডিট করছে, কেউ ক্যামেরা ধরে কাট-অ্যাকশন বলছে। এভাবেই অন্যান্য গ্রামের মতো একটি সাধারণ গ্রাম তুলশী, যেখানে শহরের মতো উঁচু উঁচু দালান নেই, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই, সেখানেই গড়ে উঠেছে এই স্বতন্ত্র ইউটিউব ভিলেজ। কী সেই যা এই গ্রামকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে সামাজিক মাধ্যমে এরকম বিল্পব তৈরি করার জন্য! 

প্রায় ৪০০০ মানুষ বসবাস করে এই গ্রামটিতে, জরিপ অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে ১০০০ জনেরও অধিক লোক ইউটিউবে সরাসরি কাজ করছেন। পুরো গ্রাম ঘুরলে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে যিনি ইউটিউবের সাথে কোনো রকমভাবে যুক্ত নয়। শুরুর দিকে অল্প কিছু লোক ইউটিউব চ্যানেল পরিচালনা করতেন, বাকিরা যেমন মহিলা, শিশু ও অন্য লোকজন তাদের ভিডিও তৈরিতে সহযোগিতা করত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে প্রায় সকলেরই নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। এতে করে গ্রামীণ উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের দিকটি অধিকতর স্পষ্ট হচ্ছে। 

ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ ইউটিউবের ২০তম জন্মদিন সম্পূর্ণ হয়েছে। প্রতি মাসে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ইউটিউব ব্যবহার করছে যার মধ্যে ভারত একটি বড় প্ল্যাটফর্ম। বছর বছর ধরে ইউটিউব শুধু আমাদের চিন্তা-চেতনা ও সংস্কৃতিরই পরিবর্তন করেনি বরং পুরো তুলশী গ্রামের প্রতিচ্ছবিও পরিবর্তন করে দিয়েছে। নীতারাম ইয়াদেভ নামক একজন ৪৯ বছর বয়সী কৃষকের মতে—ইউটিউবে ভিডিও তৈরি নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে বাচ্চারা মাদক ও পাচারসহ আরো খারাপ খারাপ অপরাধ থেকে বিরত থাকছে। এতে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিপ্লব 

সালটি ছিল ২০১৮, যখন ভার্মা ও তার বন্ধু গায়ানেন্দ্র শুকলা অলস সময় কাটাচ্ছিল, তারা তাদের প্রাত্যহিক জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না, তারা চাচ্ছিল নতুন কিছু করতে যাতে সৃজনশীলতা থাকবে, ঠিক তখনই ‘Being Chhattisgarhiya’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল নিয়ে যাত্রা শুরু করে। তাদের ৩য় ভিডিও যেটা ছিল একজন ইয়াং কাপল নিয়ে যারা ভ্যালেন্টাইন্সডেতে হিন্দু ডানপন্থি জাতীয়তাবাদী দলের লোকের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছিল। এই ভিডিওটি ইউটিউবে ব্যাপক সাড়া পেয়েছিল এবং এটাই ছিল তাদের প্রথম ভাইরাল ভিডিও। যদিও এই ভিডিওটি হাস্যরসাত্মক ছিল কিন্তু সমাজের প্রতি এটা ছিল একটা মেসেজ। এর ফলে এক মাসের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার ফলোয়ার, ১২৫০০০ সাবস্ক্রাইবার ও ২৬০ মিলিয়ন ভিউ পেয়েছিল ভিডিওটি। ফলশ্রুতিতে তারা তাদের পরিবারসহ আরো মনোযোগ সহকারে চ্যানেলটি নিয়ে কাজ করা শুরু করেছিলেন। প্রতি মাসে প্রায় ভারতীয় ৩০০০০ রুপি আয় করতেন এবং ভার্মা ও তার বন্ধু নিজেদের রেগুলার জবটি ছেড়ে দিয়ে আরো গুরুত্ব সহকারে ভিডিও তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। তাদের সফলতায় তুলশী গ্রামের লোকজন অনুপ্রাণিত হচ্ছিল, তারা একটি টিম পরিচালনা করতেন যারা ভিডিও তৈরিতে কাজ করত এবং টিমটি ছিল বেতনভুক্ত। এটুকুই যথেষ্ট ছিল পুরো গ্রামের লোকদেরকে ইউটিউবে ভিডিও তৈরি ও চ্যানেল পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ করতে। 

ছোট মোবাইল ফোন থেকে বড় পর্দায় রুপান্তর হওয়া

ইউটিউবের এই বসন্তের হাওয়ায় জন্মগ্রহণকারী সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়ার তারকাদের মধ্যে কেউই ২৭ বছরের পিংকি সাহুর চেয়ে ওপরে উঠতে পারেনি। প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষি সমাজে বেড়ে ওঠা একটি মেয়ের জন্য অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল অমাবস্যার চাঁদের মতো। বিশেষ করে এমন একটি সমাজে বেড়ে উঠেছিল সে যেখানে অভিনয়কে নিষিদ্ধ হিসেবে দেখা হতো। এত সমালোচনা সত্ত্বেও সাহু ইনস্টাগ্রাম রিল ও ইউটিউবে ছোট ছোট নাচের ভিডিও পোস্ট করতে শুরু করল। তার সাফল্য আসে যখন ‘Being Chhattisgarhiya’-এর প্রতিষ্ঠাতা তার ভিডিও দেখেন এবং তাদের নিজস্ব প্রযোজনায় তাকে নিয়োগ করেন। সাহু এটাকে তার স্বপ্ন সত্যি হওয়ার একটি পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করে। এভাবে সে ছত্তিশগড়িয়ার আঞ্চলিক সিনেমা ব্যবস্থায় স্থানীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং সাহু চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পায়। পর্যায়ক্রমে সে বিলাসপুর শহরের একজন প্রযোজক আনন্দ মানিকপুরীর প্রশংসা পেয়েছে। এভাবেই অনেক গ্রামবাসীর স্বপ্ন পূরণে কাজ করেছে ইউটিউব চ্যানেলটি। আজ জয় ভার্মা শুধু নিজের জন্য একটি নাম তৈরি করেনি, তার নৈপুণ্যের মাধ্যমে একটি সম্পূর্ণ আয়ের উৎসও তৈরি করেছে। ইউটিউব ছাড়া এসব কিছুই সম্ভব হতো না।

এছাড়াও ইউটিউব এই প্রযুক্তিগত বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দুতে মহিলাদের জন্য নতুন সম্ভাবনার পথ তৈরি করেছে। গার্হস্থ্য নির্যাতন একটি প্রচলিত বিষয়। ইউটিউব ভিডিওগুলো মহিলাদের সম্মান ও সমতা নিয়ে কথা বলে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলে। কিছু কিছু নারী ছোট ছোট ব্যবসা চালু করেছেন যেমন চুলে দেওয়া তেল, ঘরে বানানো মসলা বিক্রি ইত্যাদি। এই সকল ব্যবসার প্রচার মাধ্যম হিসেবে ইউটিউব/সামাজিক মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। 

লিংকসমূহ

১.https://www.bbc.com/future/article/20250217-how-a-tiny-village-became-indias-youtube-capital

২.https://search.app/ZQ9Y8vpVAEeSZr9j7