নিশ্ছিদ্র শহুরে জীবন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে, এক যুবক পা বাড়ায় নিঃশব্দ প্রকৃতির দিকে। তার পিঠে ভারী ব্যাকপ্যাক, চোখে গভীর কৌতূহল, আর পায়ে ক্লান্তিহীন সাহস। একা হাঁটছে সে ঘন সবুজ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, যেন সভ্যতার কোলাহল থেকে সরে গিয়ে খুঁজছে শান্তির ঠিকানা। তার নাম ক্রিস্টোফার ম্যাকক্যান্ডলেস (১৯৬৮–১৯৯২)। কিন্তু নিজের আত্মপরিচয়ের জন্য সে গড়ে তোলে এক নতুন নাম "অ্যালেকজান্ডার সুপারট্রাম্প"। এই নামেই সে আমেরিকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, মানুষের সঙ্গে দেখা করছে, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছে। আর প্রতিটি মুহূর্তে আবিষ্কার করে প্রকৃতির নতুন রূপ। তার লক্ষ্য একটাই- আলাস্কার নির্জন বনে গিয়ে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে বাঁচা। কিন্তু এই গল্পটা শুধুমাত্র একজন তরুণের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প নয়; এটা একইসাথে ভালোবাসার গল্প, হারানোর গল্প, আর জীবনের অর্থ খোঁজার গল্প। চলুন, আমরা একসাথে এই অসাধারণ যাত্রায় অংশ নিই।
সাধারণ জীবন থেকে পালানোর ইচ্ছা
ক্রিস্টোফারের জন্ম আমেরিকার এক ধনী পরিবারে। বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক জটিল, সমাজের নিয়ম-কানুন তার কাছে মনে হয় কৃত্রিম, অচেনা এক মুখোশ। একদিন বন্ধু ওয়েনকে সে জানায়, “আমি চলেছি আলাস্কায়। সত্যিকারের আলাস্কায়! কোনো ঘড়ি, কোনো মানচিত্র, কোনো কুড়াল ছাড়াই! ”
ওয়েন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “সেখানে গিয়ে করবে কী?” ওয়েনের সহজ উত্তর— “শুধু পাহাড়, প্রকৃতি, নদী, আকাশের মাঝে থাকবো, মুক্তভাবে বাঁচবো। শুধু বাঁচবো, বন্ধু!...ঐ মুহূর্তে, ঐ বিশেষ জায়গায়।”
কলেজের পাঠ চুকিয়ে সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে সে। গাড়ি, টাকা, পরিচয় সব ছুঁড়ে ফেলে। একটাই প্রশ্ন তার হৃদয়ে “সত্যিকারের জীবন কেমন?” স্বপ্ন পূরণ করতে সে প্রথমেই পৌঁছে যায় দক্ষিণ আমেরিকার মরুভূমিতে। সেখানে সে একা একা ঘুরে বেড়ায়, বই পড়ে, প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলে। তারপর সে যাত্রা করে উত্তরের দিকে, নতুন মানুষের সঙ্গে দেখা করতে।
যাত্রাপথের পরিবার
রন ফ্রাঞ্জ: রন এক বৃদ্ধ কারিগর। পরিবারহীন; একাকী জীবন তার। ক্রিস্টোফারকে দেখেই তার মনে হয়, এই ছেলেটা যেন তার হারিয়ে যাওয়া পুত্র। একদিন রন তাকে বলেই বসে, “ মাত্র ২২ বছর বয়সে তুমি চাকরি না করে, নিজের ক্যারিয়ার না গুছিয়ে এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছো কেনো?”
ক্রিস্টেফারের সরল উত্তর ছিলো, “ক্যারিয়ার? সেটা তো ২০ শতকের আবিষ্কার! আমার দরকার নেই। মানুষের আত্মা নতুন অভিজ্ঞতা থেকে মূল শক্তি পায়। যদি আমরা মানি যে জীবন শুধু যুক্তি দিয়ে চলে, তাহলে জীবনের সব সম্ভাবনাই ধ্বংস হয়ে যায়।”
ক্রিস্টোফার চলে যাওয়ার দিন, রনের চোখে জল। হয়তো তার হৃদয় বুঝে ফেলেছিল যে, এই ছেলে তার কাছে ফিরে আসবেনা আর কখনো!
জ্যান ও রেইনি: একটা ছোট্ট ট্রেলারে থাকা এই দম্পতি ক্রিস্টোফারকে তাদের পরিবারের সদস্য বানিয়ে নেয়। তবে বেশ কিছুদিন এদের সাথে থাকার পর তার আবারো মন কাঁদতে থাকে প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য। তাই সে আলাস্কার পথে আবার রাস্তায় নামে।
ট্রেসি: একটা কফি শপে কাজ করা ট্রেসির বয়স মাত্র ১৬। ক্রিস্টোফারের মুক্ত স্বভাব তাকে মুগ্ধ করে। তার যাত্রার সঙ্গে সেও শামিল হতে চায়। কিন্তু ক্রিস্টোফার বললো, "আমি কাউকে সঙ্গে নিতে পারব না। আমার যাত্রা শুধু আমার একার।"
এরপরের দুই বছর ধরে সে পৃথিবী ঘুরে বেড়াল। কোনো ফোন, কোনো পোষা প্রাণী, কোনো সিগারেট ছাড়াই। চূড়ান্ত স্বাধীনতা! তার কথায়: "আমি পশ্চিমে পালিয়েছি কারণ 'পশ্চিমই সেরা'। এখন আমার চূড়ান্ত ও মহান অ্যাডভেঞ্চার হলো ভেতরের মিথ্যা মানুষটিকে মেরে ফেলে আধ্যাত্মিক তীর্থযাত্রা শেষ করা।"
অবশেষে, স্বপ্নের শেষ গন্তব্য "আলাস্কা!"
শেষ পর্যন্ত সে পৌঁছায় আলাস্কার বনে। একটা পরিত্যক্ত বাসে আশ্রয় নেয় সে। প্রথমদিকে মনে হয় সব স্বপ্ন যেন সত্যি হয়ে গেছে। মাছ ধরে, বই পড়ে, প্রকৃতির মাঝে নিঃসঙ্গ জীবন উপভোগ করে সে। কিন্তু হায়! একদিন সে একটা মারাত্নক ভুল করে বসে। বিষাক্ত গাছ খেয়ে ফেললো। এদিকে তীব্র শীত শুরু, সাথে খাবারের মজুতও ফুরিয়ে আসতে চলেছে। ক্ষুধা আর শীতে কাতর হয়ে সে বুঝতে পারে, এবার হয়তো ফেরার পথ নেই! সেই সময় সে একটি বইয়ের মার্জিনে সে লেখে, "আমি এতোদিন ভেবেছিলাম, প্রকৃতির মাঝেই সবচেয়ে বড় সত্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু আজ বুঝলাম, সুখ তখনই পূর্ণ হয়, যখন তুমি তা কারো সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারো।"
হয়তো তখনই প্রথম সে অনুধাবন করেছিল, এতোদিন যে মুক্তির পিছনে সে ছুটছিল, সেটা প্রকৃতপক্ষে একা নয়, বরং মানুষের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায়।
যে গল্প বেঁচে থাকবে আজীবন!
ক্রিস্টোফারের মৃত্যুর পর তার ডায়েরি পাওয়া যায়। সেখান থেকে তার গল্প সারা বিশ্বে ছড়িয়ে তার গল্প আমাদের সবাইকে ভাবায় "জীবন কি শুধু টাকা-পয়সা, চাকরি, বাড়ি নাকি এর বাইরেও কিছু আছে?"
একবার সে বলেছিল, "আমাকে সত্য দাও। ভালোবাসা নয়, টাকা নয়, বিশ্বাস নয়, খ্যাতি নয়, ন্যায়বিচার নয়, শুধু সত্য।! আবার কখনো বলতো, "মানুষের সম্পর্ক ছাড়াই সুখী হওয়া যায়, ঈশ্বর তো সবকিছু আমাদের চারপাশেই রয়েছেন।"
ক্রিস্টোফার হয়তো তার সব উত্তর পায়নি। কিন্তু সে আমাদের দেখিয়ে গেছে যে, জীবনটা নিজের মতো করে বাঁচার নামই সত্যিকারের মুক্তি।
নায়ক না রোমান্টিক অবাস্তববাদী?
২২ বছর বয়সী এই তরুণটি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সেই পরিত্যক্ত বাসের ভেতরে। ক্রিস্টোফারের মরদেহ দুই সপ্তাহ পর এক শিকারি খুঁজে পায়, একটি শিয়ালের চামড়ার ব্যাগে মোড়ানো অবস্থায়। তার পাশেই রাখা ছিল একটি শেষ চিঠি: "ধন্যবাদ, প্রভু। শান্তি পেয়েছি।"
তার ডায়েরি ও ফটোগ্রাফ থেকে গল্পটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। কেউ তাকে বলে "নায়ক" যে কিনা সাহস করে সমাজের ফাঁদ ছেড়ে স্বাধীনতার পথে হেঁটেছিলো। আবার কেউ বলে "অবাস্তববাদী" যে প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলো।
তবুও সব বিতর্ক শেষে, ক্রিস্টোফারের গল্প আমাদের সামনে একটি প্রশ্নই রাখে, "জীবনের অর্থ কী? নিশ্চয়ই শুধু টাকা-পয়সা, চাকরি বা বিলাসিতা নয়। তাহলে?"
তার বই পড়ার পর ও সিনেমা দেখার পর অনেকেই আলাস্কা যাত্রা করে। কেউ কেউ বলে "এটা আমার জীবনের সেরা অভিজ্ঞতা", আবার কেউ বলে "ক্রিস্টোফারের ভুল থেকে শিখেছি"। ক্রিস্টোফারের মতে, “জীবন নিজের মতো করে বাঁচো, কিন্তু ভালোবাসাকে কখনো তাড়িয়ে দিও না। “
তার গল্প আমাদের শেখায় যে, স্বপ্ন দেখা ভালো, কিন্তু বুদ্ধিমত্তার সাথে তা পূরণ করতে হবে। সে হয়তো ভুল করেছিল, কিন্তু তার সাহস ও আদর্শ আমাদের আজও ভাবায়। শেষ পর্যন্ত, সে আমাদের দেখিয়ে যায় যে, "জীবনের মূল সত্য খুঁজে পাওয়াই আসল অ্যাডভেঞ্চার"!
আনন্দের রঙিন রাতগুলো : ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবল
একটি ছোট্ট গ্রাম ভারতের ইউটিউব রাজধানী হয়ে উঠেছে
প্রযুক্তির উন্নয়নে গ্রাম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পড়ালেখা
শাড়ি নিয়ে শিল্পীতে-অনুরাগীতে আলাপ
ক্রিস্টোফার ম্যাকক্যান্ডলেস: নিঃশব্দে প্রকৃতির পথে
জীবন থেমে থাকে না, বরং অন্যভাবে গল্প শুরু হয়
মনে হচ্ছিল আমার কোনো অঙ্গহানি হয়ে গিয়েছে
বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষন কথা বললাম
কক্সবাজার ডিভাইন রোডের পউষী রেস্টুরেন্টে মোহাম্মদ ওমর ফারুক ও মহি উদ্দিন
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছিল