সারাদিন পাহাড় ঠেলে প্রকাণ্ড এক পাথরের চাঁই ওপরে ওঠানোর পর মুহূর্তেই সেটি গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে আগের জায়গায়। পরদিন আবারও সেটিকে একইরকম রক্ত জল করা শ্রম দিয়ে ওপরে তুলতে হবে। তারপর আবার, আবার, আবার…
হ্যাঁ, দেবতাদের চটিয়ে দিয়ে অনন্ত কালচক্রে আটকে পড়া রাজা সিসিফাসের কথাই বলছি; অন্তহীন পণ্ডশ্রমই তার উপযুক্ত সাজা। তা নিয়ে পাশ্চাত্যের সাহিত্য-দর্শনে কম চর্চা হয়নি। কিন্তু ১৯৪২ সালে বের হওয়া ‘দ্য মিথ অব সিসিফাস’ বইতে দার্শনিক আলবেয়ার কাম্যু করে বসলেন এক অদ্ভুত দাবি—“One must imagine Sisyphus happy.” তা অমন উদ্ভট আবদারের কারণ কী? সেটাই একটু সহজে বুঝতে হলে ১৯৯৩ সালে বেরোনো হ্যারল্ড রামিস পরিচালিত গ্রাউন্ডহগ ডে ছবিটা নিয়ে আলাপ করা যেতে পারে।
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফিল কনর্স (বিল মারে) একজন উচ্চাভিলাষী, আত্মকেন্দ্রিক ও উদ্ধত টেলিভিশন সাংবাদিক। ছবির শুরুতে দেখা যায়, পেনসিলভানিয়ার পানক্সাটোনি (Punxsutawney) নামের ছোট এক শহরের উদ্দেশে সহকর্মী রিটা (অ্যান্ডি ম্যাকডাওয়েল) ও ক্যামেরাম্যান ল্যারিকে (ক্রিস এলিয়ট) সাথে নিয়ে যাত্রা করে ফিল। সেখানকার বার্ষিক এক উৎসব গ্রাউন্ডহগ ডে—যার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ শীতের সমাপ্তি ও বসন্তের আগমনীর সূচনা ঘটে বলে স্থানীয়দের বিশ্বাস—সেটির সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি করতে।
এখানে তিনজনের চারিত্রিক রকম-সকম নিয়ে একটু বলে রাখা ভালো। ফিল কনর্স যথারীতি উদ্ধত এবং সহকর্মীদের সাথে তার আচরণ খুব একটা বন্ধুসুলভ নয়। তার ওপর সিনিক্যাল এই ‘ভদ্রলোক’-এর ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সও বলা চলে শূন্যের কাছাকাছি কোথাও। আর এর সবচেয়ে বড় ভিক্টিম হলো রিটা—সহৃদয়, দয়ালু ও সাধারণ জীবনযাপনে উপভোগ্য ছোট ছোট উপলক্ষ খুঁজে পাওয়া এই তরুণীকে উঠতে বসতে ফিলের কর্কশ আচরণের মুখোমুখি হতে হয়। অন্যদিকে ক্যামেরাম্যান ল্যারিকে যেন ফিল পুরোপুরি মানুষ হিসেবেই গণ্য করে না। এরই মধ্যে বুদ্ধিমান দর্শকমাত্র একটা বিষয় খেয়াল করবেন—ফিল যেন প্রচ্ছন্নভাবে রিটাকে তার ড্যামকেয়ার পার্সোনালিটি দিয়ে মুগ্ধ করতে চাইছে, কিন্তু সেদিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে বরং তাকে খানিকটা বিচলিতও মনে হতে পারে। সে যা-ই হোক, রিটার প্রতি ফিলের ‘ফিলিংস’ ছবির এই পর্যায়ে গুপ্ত রাখাই ঠিক কাজ বলে মনে করেছেন নির্মাতা হ্যারল্ড রামিস।
ছবির আসল কাহিনি শুরু হয় গ্রাউন্ডহগ ডে উদযাপনের পরের দিন। দর্শকের কাছে পরের দিন মনে হলেও আসলে আমাদের ফিল কনর্স কিন্তু ভোরবেলায় জেগে ওঠে সেই গ্রাউন্ডহগ ডের দিনই। সেই একই রেডিও অনুষ্ঠান, একই মানুষের সাথে একই রকম কুশল বিনিময়, একের পর এক আগের দিনে ঘটে যাওয়া সকল কিছুর পুনরাবৃত্তি। আর এর মধ্য দিয়েই আমরা একটি চিরায়ত ‘টাইম লুপ’ সিনেমায় প্রবেশ করলাম।
তবে গ্রাউন্ডহগ ডে চিরায়ত টাইম লুপ ঘরানার হলেও মোটেও চিরাচরিত গোছের নয়। মোটাদাগে এ ধরনের জনপ্রিয় ছবিগুলোয় অসম্ভব ভীতিকর একটা আবহ তৈরি করা হয়, যেখানে পর্দায় চরিত্রগুলোকে বারবার ঘুরপাক খেতে দেখে দর্শকের মনে দুশ্চিন্তা, ভয়, আতঙ্কের মতো আদিম অনুভূতিগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঠিক এই জায়গায় গ্রাউন্ডহগ ডে সচেতনভাবে আলাদা। ছবিটি বরং কালচক্রের উপস্থাপনে খুবই ন্যাচারালিস্টিক একটা ভঙ্গি অবলম্বন করেছে। মানে এমনটা যেন খুবই স্বাভাবিক, যে কোনো দিন আপনি ঘুম থেকে উঠে দেখতেই পারেন আসলে আপনি গতদিনেই আছেন। এই ক্যাজুয়াল উপস্থাপনার কারণেই দর্শক ভয়-আতঙ্কের দ্বারা বিচলিত না হয়ে ছবিটির গভীরে লুকানো প্রশ্ন অব্দি পৌঁছানোর সুযোগ পায়—‘টাইম লুপ বা কালচক্র কি সত্যিই ভীতিকর?’ প্রশ্নটা একটু আজগুবি ঠেকে বটে; মনে হয় আপাত সংশয়াতীত একটা ব্যাপার নিয়ে এত রগড় কীসের? কিন্তু এখানেই গ্রাউন্ডহগ ডে চিরাচরিত টাইম লুপ ছবির ক্রিটিক হয়ে ওঠে।
গল্পে ফেরা যাক—ফিল কনর্সের মতো উচ্চাভিলাষী একজন মানুষের জন্য পানক্সাটোনির মতো এক মফস্বলে অনন্তকাল আটকে থাকাটা ভীতিপ্রদই বটে। তার মতো মানুষের যা করার কথা সেগুলোর সবই ফিল করে—বারবার শহর ছাড়ার ব্যর্থ চেষ্টা, ডাক্তার ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া। বলা বাহুল্য, সেসবই বিফলে।
এবারে যখন বোঝা গেল তার কাজকর্মের কোনো স্থায়ী পরিণতি নেই, তখন ফিল কনর্স আর দশটা রিপু তাড়িত মানুষের মতোই উন্মত্ত ভোগ-বিলাস ও চরম স্বার্থপর কাজকর্ম শুরু করে দিল—অপরিমিত পানাহার, সুন্দরীদের সাথে প্রেমের অভিনয়, অযথা দুর্ব্যবহার, ব্যাংক থেকে টাকাপয়সা চুরি, নিজেকে গ্রেপ্তার করানোসহ ছোটবড় নানা অপকর্ম।
প্রথমদিকে এতে আনন্দ পাওয়া গেলেও অসীম ভোগবাদও অনন্ত সময়ের সামনে দম হারিয়ে ফেলে। ছবির এই পর্যায়ে এসে রিটার প্রতি ফিলের প্রচ্ছন্ন ভালোবাসার দিকটা পুরোপুরি পাখনা মেলে। ফিল রিটাকে তার প্রেমে ফেলতে উঠে-পড়ে লেগে যায়। দিনের পর দিন রিটার পছন্দ-অপছন্দগুলো মুখস্থ করতে থাকে। নানা ফন্দি-ফিকির করেও বারবার তাকে ব্যর্থই হতে হয়; কারণ কারসাজি দিয়ে আর যা-ই হোক, ভালোবাসা মেলে না যে।
প্রেমে ব্যর্থ ফিল এবার আত্মহননের পথ বেছে নেয়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হওয়ার নয়। প্রতিবারই ফিল কনর্স ভিডিও গেমসের মতো ২ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা, গ্রাউন্ডহগ ডেতে নিজের হোটেল রুমে রিস্পন হচ্ছে।
এভাবে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে ফিল পালটাতে শুরু করে। জীবন ও সময়ের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে যায়। অনন্ত এই সময়কে প্রথমবারের মতো অভূতপূর্ব সুযোগ হিসেবে দেখতে পায়। সে নিজের পছন্দের সকলকিছু শিখে ফেলতে শুরু করে—পিয়ানো বাজানো, বরফের ভাস্কর্য তৈরি, কবিতা পড়া। কিন্তু তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, আশপাশের ‘বোরিং’ মানুষগুলোর প্রতি তার মনোযোগ ফেরে। একজন বৃদ্ধকে সাহায্য করা, একটি বাচ্চাকে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা, কিছু বৃদ্ধ মহিলার গাড়ির চাকা বদলে দেওয়া—জীবনের সাধারণ খুঁটিনাটিগুলো চমৎকার এক আগ্রহী আবেদনে ধরা দেয়; এরকম ছোট ছোট কিছু ভালো কাজের মধ্য দিয়ে এক অভূতপূর্ব তৃপ্তির অনুভূতি যেন পূর্ণতা এনে দেয়। ফলে যে শহরটিকে একসময় অনন্ত কারাগার মনে হতো, তা ধীরে ধীরে তার নিজের আপনভূমিতে পরিণত হয়।
এই পর্যায়ে এসে ছবিটি সাগ্রহে অস্তিত্ববাদী দর্শনকে আলিঙ্গন করে—জীবন যতই একঘেয়ে হোক, যতই অর্থহীন মনে হোক না কেন, আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত বা দৃষ্টিভঙ্গিই তাকে অর্থবহ করে তুলতে পারে। একইভাবে শুরু হওয়া প্রতিটি দিন—একই গান, একই মানুষ, একই ঘটনা; কিন্তু যখন ফিল নিজে বদলে যায়, তখন তার অভিজ্ঞতাগুলোর অর্থও বদলে যায়।
শেষ পর্যন্ত ফিল রিটাকে জয় করে—কোনো চালবাজি বা প্রতারণা করে নয়, বরং সত্যিকারের ভালো মানুষ হয়ে। এখানে আরেকবার আলবেয়ার কাম্যুর কথা বলা চলে—“The struggle itself is enough to fill a man’s heart.” রিটাকে ভালোবাসায় পরিপূর্ণতার যে অনুভূতি ফিলকে ভরিয়ে তোলে, সেটিই যেন অবশেষে দুজনকে একসাথে নিয়ে আসে। আর তখনই ঘটে জাদু! প্রথমবারের মতো ফিল কনর্স ৩ ফেব্রুয়ারির সকালে জেগে ওঠে। বর্তমানকে উপভোগ করতে পারার শক্তিই ফিলকে পৌঁছে দেয় নতুন ভোরে, যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে ভালোবাসার উষ্ণ আলিঙ্গন।
এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আলবেয়ার কাম্যু যখন সিসিফাসকে ‘সুখী’ কল্পনা করতে বলেন, তার শক্তিটা আসলে কোথায়। জীবনের সামনে আমরা সকলেই একেকজন সিসিফাস, কিংবা ফিল কনর্স; অনন্ত অর্থহীনতার এই ভয়াল সমুদ্রে নিজেদের উদ্দেশ্যের ডিঙা নিজেদেরই খুঁজে পেতে হবে। গন্তব্য নয়, মন ফেরাতে হবে যাত্রার সৌন্দর্যের দিকে। তাই তো, আমাদের ফিল কনর্স ৩ ফেব্রুয়ারির ভোরে ছোট্ট পানক্সাটোনিতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
রান্না যেন থেরাপি
রাঁধবি তুই! কিন্তু ফেসবুকে ফটো দিয়ে আমরা ক্রেডিট নেব
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে যা পেয়েছি তা কোনোদিন ভুলব না
কীভাবে একটি ছোট্ট গ্রাম ভারতের একটি ইউটিউব রাজধানী হয়ে উঠেছে?
মানবিক রোবট : এক নতুন যুগের সূচনা
জীবন থেমে থাকে না, বরং অন্যভাবে গল্প শুরু হয়
মনে হচ্ছিল আমার কোনো অঙ্গহানি হয়ে গিয়েছে
বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষন কথা বললাম
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছিল
দিনটায় আমি নিজেকে সময় দিতে পেরেছি
আপনি কোন সাহিত্যিকের কবিতা বা রচনা রোমান্টিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত মনে করেন?