আমার মনে হয়, ছোটবেলায় আমরা কমবেশি সবাই মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে মায়ের রান্না করার দৃশ্য দেখেছি একমনে। কোনো অজানা এক কারণে এটা আমার খুব প্রিয় একটা অভ্যাস। মা কীভাবে রান্না করে, কোন রান্নায় কোন মসলা দেন, রান্নার প্রতি মায়ের টান, একখান রসুইঘরে দিন পার করে দেওয়া—এইসব দৃশ্য আমায় খুব টানত ছোটবেলা থেকে। এমনকি ছোটবেলায় হঠাৎ রান্নার কোনো মসলা, তেল, লবণ ফুরিয়ে গেলে মা হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলত—যাও নিয়ে এসো দোকান থেকে, আর বাকি টাকা দিয়ে কিছু কিনে খেয়ো। রান্নার সাথে আমাদের প্রাথমিক স্মৃতিগুলো হয়তো কিছুটা এমনই। কিন্তু এই রান্না যে আমার থেরাপি হয়ে উঠবে তা কখনো ভাবিনি।
একটা কথা কোথায় জানি শুনেছি, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রসায়নাগার হলো রান্নাঘর। কিন্তু আমার রান্না করার জন্য এত বড় কোনো ঘরটরের ব্যবস্থা এখনো করে উঠতে পারিনি। হলের ছোট্ট একটা কুকার জুড়ে এখন আমার রান্নাঘর।
আমার দিনের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং পার্ট হলো ‘বাজার করা’। এই জিনিসে এত আনন্দ, আমি কখনো বুঝিনি। দিনশেষে যখন টিউশন থেকে বাসায় ফিরি, ফেরার পথে ইন্দিরা রোডে ঘুরে ঘুরে ভ্যান থেকে সবজি কিনে নিই রান্নার জন্য। সস্তায় সবজি কেনার জন্য ইন্দিরা রোড মন্দ না। তারপর কোনো একটা সুপারশপে ঢুকে গ্রোসারির জিনিসপত্র কেনা—ব্যাপারগুলো জীবনে নতুন মসলা যোগ করে দেওয়ার মতো। তাছাড়াও হাঁড়ি-পাতিল, রান্নার সরঞ্জাম দেখলে মনটা বেশ ভালো হয়ে যায়। একজন মেয়ে হিসেবে এটা বোধ হয় ‘adulthood'-এর একটা বড় লক্ষণ।
তবে সবচেয়ে আনন্দ আর মজার ব্যাপার হলো রান্না করা। রান্নায় হয়তো মায়ের মতো পারদর্শী আমরা কখনো হতে পারি না। তবে মনে মনে আমাদের সবার রান্নাবিষয়ক আইকন বা আদর্শ হলেন আমাদের মায়েরা। যেদিন আমি রান্নায় বাড়ির রান্নার স্বাদ নিয়ে আসতে পারি সেদিন মনটা খুব ভালো থাকে। নিজেকে কেমন যেন মায়ের মতো পাকা রাঁধুনি মনে হয়। প্রয়োজন মানুষকে কতকিছুই না শেখায়! একটা সময় ডিম ভাজতে গেলে তেল ছিটকে পড়বে বলে ভয় পেতাম। আর এখন বাজার করা থেকে রান্না করা পুরোটাই যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে।
মায়ের পর রান্নায় আগ্রহ পেয়েছি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দুই চরিত্রের কাছে। একজন ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল'-এর হাজারী ঠাকুর যে রাঁধত বেচু চক্কত্তির হোটেলে, আরেকজন ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল'-এর ইন্দুর কাছে। সাহিত্য পড়েই যেন সত্যিকার রান্নার স্বাদ পেয়েছি বিভূতিভূষণ আর কল্লোল লাহিড়ীর এই দুই লেখা তে। কী অসাধারণ রূপে ঢংয়ে রান্না আর মানুষের সম্পর্ককে তাঁরা ফুটিয়ে তুলেছেন! রান্না যে কত বড় শিল্প আর কত আনন্দের কাজ তা নতুনভাবে বুঝিয়েছেন।
রান্না করা শুধু প্রয়োজন বা আনন্দ না, এটা একটা ধ্যান। সারাদিনের ক্লান্তির পর রান্না করতে বসা আমার জন্য একটা রিলাক্সেশন। এমনকি আমি এই লেখাটাও লিখছি কুকারে খিচুড়ি চাপিয়ে দিয়ে। মাঝেমধ্যে ভাবি খিচুড়ি ভারতের মতো আমাদের দেশেরও জাতীয় খাবার হওয়া উচিত ছিল। খিচুড়ির সাথে বেগুন ভাজা, কিছু একটা ভর্তা, আরো জমানোর জন্য সাথে কষা মাংস! বাঙালির কাছে অমৃত সমান। পাপড় ভাজা আর চাটনি হলে তো কোনো কথাই নেই! আর শেষ পাতে একটা রসগোল্লা কিংবা দই হলে তো সোনায় সোহাগা।
বেশ কিছু বছর বাড়ির বাইরে অবস্থান করছি। তাই কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, বাড়ির সবচেয়ে কোন বিষয়টা মিস করি। তাহলে নিঃসন্দেহে আমাদের অধিকাংশের উত্তর হবে ‘মায়ের হাতের রান্না’। মায়েদের রান্নায় একটা জাদু আছে। পৃথিবীর সব দামি খাবার খেয়ে ফেললেও যে রান্নায় এসে আমাদের মন, মস্তিষ্ক, জিহ্বা আটকে যায় সেটা হলো মায়ের হাতের রান্না। মা রান্নায় শুধু মসলা মেশায় না, সাথে মেশায় যত্ন, আদর আর ভালোবাসা। তাই মায়ের ভালোবাসা মেশানো রান্না পৃথিবীর সেরা খাদ্য।
তবে হলে/হোস্টেলে সবাই মিলে রান্নার আয়োজনটাও কিন্তু কম যায় না। বলা চলে, হলে কাটানো সময়ের সবচেয়ে প্রিয় ব্যাপারগুলোর একটি হলো সবাই মিলে রান্না করে খাওয়া। আর একসাথে খাওয়ার আবার বিভিন্ন নামও আছে বটে যেমন—ভর্তা পার্টি/খিচুড়ি পার্টি/রুম পার্টি আরো কত কী!
দিনশেষে আমি যখন রান্না করি আমার মনে হয় সকল ক্লান্তি চলে যায় কুকারের হিটের সাথে। সকল নেগেটিভিটি দূর হয়ে যায় খুন্তি নাড়ানোর সাথে। আর রান্না মুখে তোলার সাথে সাথে আমি অনুভব করি এক স্বর্গীয় সুখ, যা আমার শরীর, মন দুটোর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এখন সুযোগ থাকলেও আমি বাইরে থেকে খাবার কিনে বা অর্ডার করে খাই না। সময় নিয়ে রান্না করে মন ,আত্মা দুটোই শান্তি করা এখন আমার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যা আমি খুঁজে পাই আমার ‘comfort food' ভাত, ঝুরঝুরে আলুভাজা আর ঘন মসুর ডালে। মাঝেমধ্যে এই কম্ফোর্ট ফুডে ডিম ভাজিও শক্তপোক্ত একটা জায়গা করে বসে। কারণ ব্যাচেলরদের জীবনে ডিম হলো জাতীয় খাবার। সকাল, দুপুর, রাত আমরা ডিম ভাজি, ডিম ভুনা, ডিম ভর্তা, ডিম সেদ্ধ খেয়ে পার করে দিতে পারি অনায়াসে। তবে ইদানী সকালের নাশতায় ডিম ভাজি আর ভাতের জায়গাটা কেড়ে নিয়েছে ম্যাগি নুডলস। ম্যাগি আমার জীবনের সেই বন্ধু যে বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে ঢাল হয়ে। বিপদে পড়ার দুই মিনিটেই যে বন্ধু হাজির হয়, ক্ষুধার্ত অবস্থায় দুই মিনিটে ম্যাগিও এভাবেই হাজির হয়ে ক্ষুধা মেটায়।
জীবন পাল্টাচ্ছে সময়ের সাথে সাথে, পাল্টে যাচ্ছে খাবারের ধরন, স্বাদ আর সাথে সাথে রান্নায় পারদর্শী হয়ে উঠছি নিঃসন্দেহে। বিষয়টা কিন্তু বেশ মজার!
রাঁধবি তুই! কিন্তু ফেসবুকে ফটো দিয়ে আমরা ক্রেডিট নেব
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে যা পেয়েছি তা কোনোদিন ভুলব না
কীভাবে একটি ছোট্ট গ্রাম ভারতের একটি ইউটিউব রাজধানী হয়ে উঠেছে?
মানবিক রোবট : এক নতুন যুগের সূচনা
হেলথকেয়ারে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স : ভবিষ্যতের আশার আলো
জীবন থেমে থাকে না, বরং অন্যভাবে গল্প শুরু হয়
মনে হচ্ছিল আমার কোনো অঙ্গহানি হয়ে গিয়েছে
বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষন কথা বললাম
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছিল
দিনটায় আমি নিজেকে সময় দিতে পেরেছি
আপনি কোন সাহিত্যিকের কবিতা বা রচনা রোমান্টিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত মনে করেন?