আমরা যখন হাঁটছিলাম, তখন ঘন কুয়াশায় ঢাকা চারিধার


  • কুহেলিকা মল্লিক  বিশ্বম্ভরপুর, সুনামগঞ্জ |
  • প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৪৯
নাই নেট
ফোটোঃ এআই দিয়ে তৈরি

জীবনজয়ীর নাই নেটে অংশ নেয়ার আহবান আগেই পেয়েছিলাম। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলাম যে বছরের প্রথম দিনটা ফোন ফেসবুক ইউটিউব টেলিভিশনসহ যাবতীয় ইন্টারনেট সংযোগ থেকে দূরে রাখবো। পহেলা জানুয়ারি ভোর ছয়টা নাগাদ মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলে দেখি মা অলরেডি বাইরে হাঁটতে যাওয়ার জন্য রেডি। আমি যাবো কিনা জানতে চাইলো। আমার তখনো চোখ জুড়ে ঘুম। কিন্তু বছরের প্রথমদিন মায়ের মুখের উপর না বলবো! উঠে পড়লাম। ঝটপট রেডি হয়ে নিলাম। 

বাড়ির পেছনে সড়ক দিয়ে আমরা যখন হাঁটছিলাম, তখন ঘন কুয়াশায় ঢাকা চারিধার। এই রাস্তা দিয়ে সামনে ২০/২৫ মিনিট হাঁটলেই মামাবাড়ি। মাকে বললাম, “ চলো যাই। অনেকদিন তো যাওয়া হয় না। আজ সবাইকে অবাক করে দেই।” মা রাজি হয়ে গেলো। তারপর যেই ভাবা সেই কাজ। দ্রুতপায়ে হেঁটে মা-মেয়ে মামাবাড়ি পৌঁছে দেখি ছোটমামা উঠানে খড় শুকনো পাতা লতা দিয়ে আগুন ধরিয়েছে আর চারপাশে বাচ্চারা সব আগুন পোহাচ্ছে। আমিও দেরি না করে আগুন পোহাতে বসে গেলাম। দিদিমা তখন স্নান সেরে ঠাকুরঘরে পূজা দিচ্ছিলো। প্রসাদ নিয়ে বাইরে এসেই একটা বাতাসা মুখে তুলে দিলো। খানিকবাদেই মামী নাস্তা নিয়ে হাজির। বাটিতে মুড়ি চিনি আর কুরানো নারকেল মাখা। সাথে গরম গরম গুড়ের চা। বেশ আয়েশ করে খেলাম। কিছুক্ষণ সবার সাথে আড্ডা-হুল্লোড়ে কাটাতেই মায়ের তাগিদ শুরু।

আটটা প্রায় বেজে গেলো। এখনি বাড়ি পৌঁছাতে হবে। না হলে মায়ের স্কুলে যেতে লেট হবে। দিদিমা বাড়ির সামনের নিজের হাতের বোনা সবজি ক্ষেত থেকে কুমড়ো ফুল আর লাউশাক তুলে সাথে দিয়ে দিলো। বাড়ি এসে দেখি বাবু ততক্ষণে উঠে পড়েছে। বারান্দায় বসে পেপার পড়ছে। রান্নাঘরে মাকে শাকসবজি কেটেকুটে রেডি করে দিলাম। মা রান্না করে নিলো। সকাল সকাল সবাইকে নিজ হাতে পরিবেশন করে খেতে দিলাম। গরম ধোঁয়া উঠা ভাত সাথে লাউশাক বেগুন ভাজি আর কুমড়ো ফুলের বড়া। টিফিন গুছিয়ে মা ও বাবুকে। ওরা স্কুলের জন্য বেরুলে আমি ঘরে কাজগুলো সেরে স্নান করে নিলাম। দুপুর হয়ে গেছে। মধ্য দুপুরে বাড়িতে একলা থাকার সময়গুলো যেন কাটতেই চাচ্ছে না। এঘরে কিছুক্ষণ বসি। আবার পাশের ঘরে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি। আজ আমার নেট নেই। দিনটাকে আমি কাজে লাগাতে চাই।


টেবিলে বাবুর ওষুধ বক্সটা নিয়ে বসলাম। ঠাসাঠাসি করে ওষুধ রাখায় ঢাকনাটা ঠিক করে আটকানো যাচ্ছিলো না। ওষুধ বিছানার ঢাললাম। শেষ হয়ে যাওয়া ক্যাপসুলের পাতার বাড়তি অংশ কাঁচি দিয়ে কেটে আলাদা করে নিয়ে সলিড গুলো রেখে বক্সটা ভালোভাবে গুছিয়ে রাখলাম। দুপুরে বইয়ের সেলফ গাদাগাদি করে রাখা বইয়ের স্তুপ অনাদরে ধূলো জমেছে। একে একে সব বই নামিয়ে ঝেড়ে মুছে রাখলাম। একটা পুরোনো ডায়েরিতে হাত পড়লো। ২০১০ সালের। হিসেব করে দেখলাম তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। নিয়মিত ডায়েরী লেখার অভ্যেস ছিলো। কত হাবিজাবি লেখা ওতে। পছন্দের কিছু গান। দু’একটা কবিতা লিখার বৃথা চেষ্টাও চোখে পড়লো। দু’এক জায়গায় মন খারাপের কিছু লাইন। আজকে ৫০ টাকা হারিয়ে গেছে। মন খুব খারাপ। বেস্টফেন্ডের সাথে ঝগড়া’ এদিন কোনদিন ভুলবো নাহ। টিফিনে সবাই আমাকে বাদ দিয়ে ঝালমুড়ি খেতে গেছে; পরীক্ষায় এদের থেকে বেশি মার্ক পেয়ে দেখিয়ে দেবো। এমন টাইপের সব লেখা। পড়ে কেবলই হাসলাম। ডায়েরীর ভাঁজে শুকনো কয়েকটা সূর্যমুখী ফুলের পাঁপড়ি। পাঁপড়িগুলোর গায়ে লেখা বনানী, মুনিয়া, পারু। একদিন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বান্ধবীরা সবাই মিলে সূর্যমুখী বাগানে ঘুরতে গিয়ে একটা ফুল চুরি করেছিলাম। কয়টা পাঁপড়িই ভাগে পেয়েছিলাম। নস্টালজিক হচ্ছি একটু। পুরোনো আলমারি হাতড়ে গিফট বক্সটা বের করলাম। এতে আমার সব প্রিয় উপহার যা বিভিন্নসময় বান্ধবীদের কাছ থেকে পেয়েছিলাম। এখনো কত যত্নে রাখা আছে। একটা বড় খাম। খামের ভেতরে ঠাসা চিঠি কয়েকটা চিঠি খুলে পড়লাম বেশ হাসলাম। বেশ অবাক হয়ে দেখলাম চিঠিগুলোর বয়সও ১৪/১৫ বছর। সময়কে আমরা ধরে রাখতে পারি না। তবে চাইলে কিছু সময় হয়তো এভাবেই বাক্সবন্দী করে রেখে যায়। কখনো অবসরে একলা লাগলে খুলে বসে উষ্ণতা কুড়ানো যায়।


সেলফ থেকে শরৎ চন্দ্রের একটা বই নিয়ে কয়েকপেজ পড়তেই ঘুম লেগে এলো চোখে। আজ আমি নেটে নেই। অদ্ভূত এক স্বপ্ন দেখলাম। মা বাবু আমি দিদিভাই সবাই মিলে নৌকা করে কোথাও ঘুরতে যাচ্ছি । হাওরের একপাশে অনেক পাখি একসঙ্গে বসে আছে। দিদি বললো, “এরা শীতের অতিথি পাখি”। আমি তখন কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না এই পাখিরা যেন কোন দেশ থেকে আসে? ভাই একটা শিস বাজাতেই পাখিগুলো সব একসঙ্গে উড়ে গেলো। এত পাখির একসঙ্গে ডানা ঝাপটানোর শব্দে আমি কেঁপেই উঠছিলাম। তখনি ঘুম ভাঙলো। মা এসে গেইটে কড়া নাড়ছিলো। গেইট খুলে দিতে গিয়ে সামনের রাস্তায় বাবুকে বাজার ব্যাগ বয়ে নিয়ে আসতে দেখে ছুটলাম ব্যাগ আনতে। ছোটবেলা থেকে, এভাবেই বাবুকে বাজার করে ফিরতে দেখলে দৌড়ে যেতাম - না জানি ব্যাগে কত মজা আছে। বেশিটা আমারই চাই সেজন্য দৌড়। এখন আর মজা খাওয়ার লোভে নয়। বয়সের কারণে নিজের মাঝে যেটুকু দায়িত্ববোধ তা দিয়ে বাবার ভার কিছুটা কমানোর চেষ্টা। ব্যাগ নিতে নিতে বাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “শীতে অতিথি পাখিরা যেন কোন দেশ থেকে আসে”। সাথে সাথেই বলে দিলো, “সাইবেরিয়া”। অথচ এতক্ষণ চেষ্টা করেও নামটা মাথায় আসছিলো না। ব্রেনে খুব আরামবোধ হলো। মনে হলো বহু কাঙ্ক্ষিত কিছু শোনার অপেক্ষায় যে ব্যাকুলতা তৈরী হয়েছিলো তা কেটে গেছে।


সারা দিনে নেটে হাত দিই নি। সন্ধ্যা কাটলো সবাই মিলে চা-সিঙ্গারা আর পিঠা খেয়ে। নতুন বছর উপলক্ষ্যে ডিনারে স্পেশাল মেন্যু চিকেন কষা আর আলুর পরোটা; সাথে পায়েস। নিজ হাতে রান্নাবাড়া করে পরিবারের সবাইকে বেড়ে খাওয়ানোর কি যে সুখ! সবাইকে তৃপ্তি করে হাসিমুখে খেতে দেখতে পাওয়ার দূশ্য কি যে নির্মল অমূল্য সুন্দর! খুব সুন্দর একটা দিন কাটিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভাবলাম এত সুন্দর উপলব্ধিগুলো ইন্টারনেটের বাইরে থাকার সুবাদেই সম্ভব হলো। আজকাল আমরা সবাই খুব বেশি যান্ত্রিক হয়ে গেছি। বেশিরভাগ সময় চোখ পড়ে থাকে স্ক্রীনে। সবার সাথে দেখা করি সোশ্যাল মিশিয়ায়। নিউজফিড দেখে ভালো লাগলে জুম করি; নাহয় স্ক্রল করে নিচে নেমে আসি । সুন্দর কিছু ভাবার অনুভব করার সময়ই যেন নেই। বছরে ইন্টারনেট ছুটি বলে কিছু থাকলে বেশ হোতো। এই ছুটিতে ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ। মানুষ ছুটি কাটাবে নিজের মত করে নিজের সব মানুষদের সাথে। এরকম কিছু ভাবতে ভাবতে ঘুম চলে এলো। আমার ইন্টারনেটবিহীন অতিসুন্দর দিনের পরিসমাপ্তি হোলো।



ক্যাটাগরি: নাই নেট

         

  রেটিং: ০

এই বিভাগের আরও পোস্ট

রসিঘর

রাঁধবি তুই! কিন্তু ফেসবুকে ফটো দিয়ে আমরা ক্রেডিট নেব

  • মোঃ ইমরুল ইউসুফ|
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: রসিঘর

ক্যাম্পাস

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে যা পেয়েছি তা কোনোদিন ভুলব না

  • সজীব কুমার মন্ডল |
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: ক্যাম্পাস

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

কীভাবে একটি ছোট্ট গ্রাম ভারতের একটি ইউটিউব রাজধানী হয়ে উঠেছে?

  • খাদিজা আক্তার |
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

মানবিক রোবট : এক নতুন যুগের সূচনা

  • বর্ষা রানী দে|
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

হেলথকেয়ারে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স : ভবিষ্যতের আশার আলো

  • অর্ণব মিত্র উৎসব|
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

সর্বশেষ

সবচেয়ে পঠিত

মনে হচ্ছিল আমার কোনো অঙ্গহানি হয়ে গিয়েছে

মনে হচ্ছিল আমার কোনো অঙ্গহানি হয়ে গিয়েছে

  • সুরাইয়া সারমিন , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নাই নেট

বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষন কথা বললাম

বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষন কথা বললাম

  • উসরাত জাহান নিতু , বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
নাই নেট

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছিল

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছিল

  • ইমরান চৌধুরী , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নাই নেট

দিনটায় আমি নিজেকে সময় দিতে পেরেছি

দিনটায় আমি নিজেকে সময় দিতে পেরেছি

  • আশা আক্তার জুঁই , রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
নাই নেট

আজকের জরিপ 01

আপনি কোন সাহিত্যিকের কবিতা বা রচনা রোমান্টিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত মনে করেন?