জুনকো তাবেই : আমি একবারের জন্যও হার মানার কথা ভাবিনি


  • অনুবাদ : রিতু চক্রবর্তী  ঢাকা, বাংলাদেশ |
  • প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৫, ১৭:২৯
সাক্ষাৎকার
ছবিঃ উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া

জুনকো তাবেই (১৯৩৯-২০১৬) ছিলেন একজন জাপানি পর্বতারোহী। তিনি পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট আরোহণকারী প্রথম নারী। তাবেই ১৯৭৫ সালের ১৬ মে এই অসাধ্য সাধন করেন। তার এই অর্জনের মধ্য দিয়ে অনুমেয়ভাবেই পৃথিবীতে নারীর অগ্রযাত্রায় এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। এভারেস্ট জয়ের পাশাপাশি জুনকো ১৯৯২ সালে প্রথম নারী হিসেবে ‘সপ্তশিখর’-এ (অর্থাৎ পৃথিবীর সাতটি মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ পর্বতচূড়া) আরোহণ করার কৃতিত্ব অর্জন করেন। ২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর, পর্বত আরোহণের ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পৃথিবীকে চিরবিদায় জানান। মৃত্যুর কিছুদিন আগে, ব্র্যাড ফার্নেট নামের এক সাংবাদিক তাবেই-এর একটি  সাক্ষাৎকার নেন। 

তাবেইকে নিয়ে খোঁজখবর করতে গিয়ে ব্র্যাড, বুঝতে পারেন যে এই কিংবদন্তি নারীর বিষয়ে খুব বেশি কথা মানুষ জানেন না। তাবেই-এর মৃত্যুর কয়েক মাস আগেই ব্র্যাড তার সাথে যোগাযোগ করেন। তখনও ব্র্যাড জানেন না বিশ্বজয়ী এই নারী ক্যানসার নামক শত্রুর সাথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সাক্ষাৎকারটি নেওয়ার কিছুদিন পরে তাবেই মারা যান। তাবেইকে শ্রদ্ধা জানাতে প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে এই সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেন ব্র্যাড। সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো : 

আপনার প্রথম পর্বত আরোহণের অভিজ্ঞতা শুরু হয়েছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, যখন আপনি আগ্নেয় পর্বত নাসু আরোহণ করেছিলেন। পর্বত আরোহণ সম্পর্কে আপনার মনে প্রথম অনুভূতি কী ছিল?

তাবেই : পাথুরে শুকনো পাহাড়গুলো আর একটি গরম পানির প্রবাহ দেখে আমি রীতিমতো হতবাক হয়ে গেছিলাম। তখন বেশ গরম ছিল। কিন্তু আমরা যখন পাহাড়ের একদম মাথায়, তখন একটা শীতল অনুভূতি হচ্ছিল। এই বিষয়টাও অবাক করার মতো ছিল। তখন আমি বুঝলাম যে পৃথিবীতে অনেক কিছু আছে যা আমি কখনও দেখিনি। তখনই ঠিক করে ফেললাম যে আমি পৃথিবীটাকে কাছ থেকে দেখব।  

আপনি ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে ইংরেজি সাহিত্য পড়তে গিয়েছিলেন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্নাতক করার পর আপনি নারীদের জন্য একটি পর্বত আরোহণ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সে ক্লাবটি ক্যাম্পাসে আপনার অভিজ্ঞতার প্রেরণায় তৈরি হয়েছিল কি?

তাবেই : তখন ফুকুশিমায় হাইস্কুলগুলোতে খুব বেশি মেয়ে ছিল না,  বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া তো দূরের কথা। তবে আমার গল্পটা ভিন্ন বলতে পারেন। আমি আবার আমার কথায় ফুকুশিমার আঞ্চলিক টানের জন্য এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগতাম। কারণ আমার ক্লাসের বাকি মেয়েরা এসেছিল শহর থেকে। এসবের মধ্যেই একজনের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল যে কিনা আমার মতোই পাহাড় ভালোবাসে। আরও কিছু ছেলের সাথে আলাপ হলে জানলাম ওরা সবাই এরকম একটা ক্লাবের সদস্য। নাম আল্পাইন। সত্যি বলতে খুবই হিংসে হয়েছিল এটা শুনে। 

১৯৬২ সালে, আমি স্কুলের বাইরে একটি ছোট পর্বত আরোহণ ক্লাবে যোগ দেই। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আমি পাহাড়ি এলাকায় চলে যেতাম। আমি সেসব জায়গায় প্রশিক্ষণ নিতাম। আমি তখন নারীদের একটি দল নিয়ে হিমালয় যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। এ কারণেই, আমরা ‘লেডিজ ক্লাইম্বিং ক্লাব’ গঠন করেছিলাম। ১৯৭০-এর দশকে, জাপানের যে কোনো ক্লাব যদি হিমালয়ে যেতে চাইত, তবে তাদের জাপান মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন (JMA)-এর নিবন্ধিত সদস্য হতে হতো এবং তাদের সুপারিশ দরকার হতো। প্রথমবার আমাদেরকে সুপারিশ দেয়নি  জাপান মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন। তবে পরে তারা আমাদের আবেদন গ্রহণ করে, যার ফলে ১৯৭০ সালের অন্নপূর্ণা ৩ অভিযানে যাওয়া সম্ভব হয়।

যখন আমরা এভারেস্ট অভিযানের পরিকল্পনা করি, তখন আল্পাইন কমিউনিটির অধিকাংশ পুরুষ এর বিরোধিতা করেছিল। তারা বলত যে নারীদের পক্ষে এভারেস্টে যাওয়া সম্ভব নয়।

এভারেস্টে যাওয়ার আগে কি কখনো এমন মুহূর্ত এসেছিল যখন আপনার মনে হয়েছে যে এটা আসলেই আপনার জন্য সম্ভব নয়?

তাবেই : না, আমি একবারের জন্যও হার মানার কথা ভাবিনি। আমরা পর্বত আরোহণের অনুমতি পাওয়ার জন্য এত কঠোর পরিশ্রম করেছিলাম যে হাল ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারিনি।

তখন নারীদের এভারেস্ট অভিযানের জন্য অর্থ সংগ্রহ কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?

তাবেই : ভীষণ রকম। ১৯৭২ ১৯৭৩ সালে বিশ্বজুড়ে এক গুরুতর অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়, যেটি তেল সংকট বাওয়েল শকনামে পরিচিত। 

 

অর্থনীতি শিথিল হয়ে গিয়েছিল। যেখানে যেখানে আমরা আমাদের অভিযান পরিকল্পনা নিয়ে গিয়েছিলাম, সবাই বলছিল যে টাকা নেই। আরো বলা হয়েছিল যে শুধু নারীদের পক্ষে এভারেস্টে যাওয়া অসম্ভব। ভাগ্যক্রমে, একটি প্রধান সংবাদপত্র, ইয়োমিউরি, এবং একটি টিভি স্টেশন, এনটিভি, আমাদের স্পনসর হতে রাজি হয়। 

আপনি ৬,৩০০ মিটার উচ্চতায় একটি তুষারধসের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ঐ ঘটনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

তাবেই : মে ৪ তারিখ, মধ্যরাত্রির একটু পর, আমরা পাঁচজন ক্যাম্প ২-এর একটি তাঁবুতে ঘুমাচ্ছিলাম। কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের ওপর তুষার ধসে পড়ে।  আমরা তুষারের নিচে চাপা পড়ে যাই। আমি তাঁবুর মধ্যে আটকে গিয়েছিলাম  আর  অন্য চারজন সদস্য আমার ওপর এসে পড়েছিল। আমি শ্বাস নিতে পারছিলাম না, মনে হচ্ছিল মরে যাব। আবার সেইসাথে আরেকটা বিষয়ও ভাবছিলাম যে আমাদের এই  দুর্ঘটনাটি কীভাবে রিপোর্ট করা হবে। তারপর হঠাৎ করে, শেরপারা যেন দেবদূত হয়ে আমাকে উপরে টেনে তোলে। বলা যায় তারা আমাকে নতুন জ়ীবন দেয়। খুব ভাগ্যবান ছিলাম যে আমাদের কেউ আঘাত পায়নি, কিন্তু তবুও তিন দিন লেগেছিল স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে । 

তারপর কি আপনি অভিযান ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবলেন?

তাবেই : বেস ক্যাম্পে থাকা দলনেতা এবং দলের ডাক্তার উভয়ই জোরাজুরি করেছিলেন যে আমাদের সবাইকে নিচে চলে যেতে হবে, কিন্তু আমি ঘোষণা করেছিলাম, সবাই গেলেও আমি যাব না। বাকি সদস্যরাও আমার সাথে একমত হয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ওপরে যাব।

কে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রথম আরোহী কে হবে?

তাবেই : কোন সদস্যকে শীর্ষে যেতে হবে তা সিদ্ধান্ত নেওয়া আমাদের জন্য কঠিন ছিল। প্রথমে, ইউরিকো ওয়াতানাবে এবং আমি প্রথম আরোহী দলের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হই। তারপর, যখন আমরা ক্যাম্প ৪-এ পৌঁছেছিলাম, তখন জানতে পারি যে শেরপাদের অর্ধেক অসুস্থ এবং তারা পর্যাপ্ত অক্সিজেন বোতল ওপরের ক্যাম্পে নিতে পারছিল না। সুতরাং, আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল কে ওপরে যাবে এবং কে নিচে নামবে। আমি জোর দিয়ে বললাম যে ওয়াতানাবে-সান ওপরে যাবে, এবং তিনি জোর দিয়ে বললেন যে আমি ওপরে যাব। পরের সকালে, আমাদের দলনেত্রী ত্রিকো হিসানো রেডিওতে কল করে বললেন, “তাবেই-সান, আপনি উপরে যাবেন।” এটা খুবই দুঃখজনক ছিল যে ওয়াতানাবেকে নিচে চলে যেতে হলো। পরে আমি একাই ওপরে  চলে গেলাম।

আপনি ১৬ই মে ১৯৭৫ এবারেস্টের চূড়ায় পৌঁছেছিলেন। আপনি যখন সেখানে পৌঁছালেন, প্রথমে কী ভাবলেন? সে মুহূর্তটি চিহ্নিত করার জন্য কী  করেছিলেন?

তাবেই : আমি  চিৎকার করিনি। প্রথমেই মনে হয়েছিল, “ওহ, তাহলে এখন আর পাহাড় বাইতে  হবে না!।” আমরা তখন অবশ্য ছবি তোলার, ৮ মিমি সিনেমা তৈরির এবং বেস ক্যাম্পে রেডিও কল করার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া থেকে তিব্বতের সমতল এবং বাদামি পাহাড়ের দৃশ্য এবং নেপালের পাথুরে গ্লেসিয়ারের দৃশ্য দুটি একেবারেই ভিন্ন ছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলাম। আমি জানতাম না যে অন্য দিকে একটি চীনা অভিযানে নারীরা অংশগ্রহণ করছিল। তারা এর  ১১ দিন পরই এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছায়।

এভারেস্ট জয় করে ঘরে ফেরার অনুভূতি কেমন ছিল?

তাবেই : অনেক মিডিয়া কর্মী ছিল। পরিবারের সাথে সময় কাটানোর জন্য প্রায় সময়ই ছিল না। আমার তিন বছরের মেয়ে সমস্ত ক্যামেরা দেখে ভয় পেয়েছিল। সম্রাট, ক্রাউন প্রিন্স, এবং রাজকুমারী সবাই আমাদের রাজপ্রাসাদে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী, শ্রমমন্ত্রী, এবং সংস্কৃতি ও শিক্ষামন্ত্রী আমাদের লাঞ্চে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। নেপাল সরকার আমাকে সম্মাননার পদক দিয়েছিল। তারপরও অনেক আমন্ত্রণ এবং বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমাকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। সেই অর্থে ঘরে থিতু হতে আমার দুই মাস লেগেছিল। আমি শুধু একটি পর্বতই আরোহণ করেছিলাম। কিন্তু আমার চারপাশের পরিবেশ এমন হওয়ার একটাই কারণ- এভারেস্ট জয়ী প্রথম নারী আমি  ছিলাম, যদিও আমি প্রথম হওয়ার উদ্দেশ্যে সেখানে উঠিনি। 

আপনি এভারেস্টের পরও সেভেন সামিটস এবং তারপর আরও অনেক শৃঙ্গ আরোহণ করেছেন। কী আপনাকে আরোহণ করতে উৎসাহিত করে? 

তাবেই : আমি পাহাড় ভালোবাসি। আমি যেখানে কখনো যাইনি, সেখানে যাওয়ার তাড়না অনুভব করি। তাই আমি পৃথিবীর সব দেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গগুলো আরোহণ করবই এমন একটা চ্যালেঞ্জ নিজেই নিজেকে করেছি। আমার বয়স এখন ৭৬ বছর, এবং ৭৬টি দেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আমি উঠেছি।  এই মুহূর্তে ক্যানসারে ভুগছি। তবুও আমি পাহাড়ে উঠতে চাই। 

যদি আপনি আবার সেই আগের সময়ে ফিরে যেতে পারেন, এবং একটি শিশুর মতো নিজেকে কিছু পরামর্শ দিতে পারেন, তা হলে কী পরামর্শ দিতেন? 

তাবেই : থেমো না, এগিয়ে যাও সামনে। 


ক্যাটাগরি: সাক্ষাৎকার

         

  রেটিং: ০

এই বিভাগের আরও পোস্ট

রসিঘর

রাঁধবি তুই! কিন্তু ফেসবুকে ফটো দিয়ে আমরা ক্রেডিট নেব

  • মোঃ ইমরুল ইউসুফ|
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: রসিঘর

ক্যাম্পাস

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে যা পেয়েছি তা কোনোদিন ভুলব না

  • সজীব কুমার মন্ডল |
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: ক্যাম্পাস

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

কীভাবে একটি ছোট্ট গ্রাম ভারতের একটি ইউটিউব রাজধানী হয়ে উঠেছে?

  • খাদিজা আক্তার |
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

মানবিক রোবট : এক নতুন যুগের সূচনা

  • বর্ষা রানী দে|
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

হেলথকেয়ারে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স : ভবিষ্যতের আশার আলো

  • অর্ণব মিত্র উৎসব|
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

সর্বশেষ

সবচেয়ে পঠিত

মনে হচ্ছিল আমার কোনো অঙ্গহানি হয়ে গিয়েছে

মনে হচ্ছিল আমার কোনো অঙ্গহানি হয়ে গিয়েছে

  • সুরাইয়া সারমিন , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নাই নেট

বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষন কথা বললাম

বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষন কথা বললাম

  • উসরাত জাহান নিতু , বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
নাই নেট

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছিল

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছিল

  • ইমরান চৌধুরী , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নাই নেট

দিনটায় আমি নিজেকে সময় দিতে পেরেছি

দিনটায় আমি নিজেকে সময় দিতে পেরেছি

  • আশা আক্তার জুঁই , রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
নাই নেট

আজকের জরিপ 01

আপনি কোন সাহিত্যিকের কবিতা বা রচনা রোমান্টিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত মনে করেন?