নিকোলাস উইন্টনের পরোপকারের গল্প এমন এক মানবতার উদাহরণ, যা যুগ যুগ ধরে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে, যখন নাৎসি জার্মানি শক্তি প্রদর্শনে মেতে উঠেছিল, উইন্টন তাঁর সাহসিকতা এবং দয়ার মাধ্যমে ৬৬৯ শিশুর জীবন রক্ষা করেছিলেন। তার এই প্রচেষ্টা ছিল নিঃশব্দ কিন্তু গভীর প্রভাববাহী।
নিকোলাস উইন্টন ছিলেন একজন ব্রিটিশ ব্যাংকার। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৯। ছুটি কাটানোর জন্য তিনি সুইজারল্যান্ডে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু তাঁর এক বন্ধু তাঁকে চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগে আসার অনুরোধ করেন। উইন্টন প্রাগে পৌঁছে দেখেন, ইহুদি পরিবারগুলো নিজেদের সন্তানদের নিরাপত্তার জন্য হাহাকার করছে। তিনি নাৎসি শাসনের নির্মমতা ও ইহুদি পরিবারের দুঃখ-দুর্দশা দেখে গভীরভাবে মর্মাহত হন। উইন্টন বুঝতে পেরেছিলেন, শরণার্থী শিবিরে থাকা শিশুদের দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানো জরুরি। এই শিশুদের জীবন রক্ষার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তিনি ব্রিটেনে শিশুদের নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি পরিকল্পনা শুরু করেন। উইন্টন ব্রিটিশ সরকার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে যোগাযোগ করেন। ব্রিটিশ সরকার তখন একটি আইন চালু করেছিল, যার অধীনে নির্দিষ্ট সংখ্যক শরণার্থী শিশুকে দেশে আনার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তবে শর্ত ছিল, প্রত্যেক শিশুর জন্য একটি গ্যারান্টর বা স্পন্সর থাকতে হবে, যারা তাদের খরচ বহন করবে।
উইন্টন ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করতে থাকেন। নিজেই ব্রিটেনে ফিরে গিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন। তিনি রাতের পর রাত জেগে কাজ করতেন, শিশুদের নাম নিবন্ধন করতেন এবং পরিবার খুঁজে বের করতেন। তিনি মানুষের কাছে আবেদন করেন, যেন তারা এই শিশুদের গ্রহণ করেন। অনেক পরিবার এগিয়ে আসে। একই সঙ্গে তিনি ট্রেন এবং অন্যান্য পরিবহন ব্যবস্থা সংগঠিত করেন, যাতে শিশুদের নিরাপদে চেকোস্লোভাকিয়া থেকে যুক্তরাজ্যে আনা যায়। উইন্টন শিশুদের জন্য যে ট্রেনের ব্যবস্থা করেন, যেগুলোকে পরে ‘কিন্ডারট্রান্সপোর্ট’ নামে ডাকা হতো। এই ট্রেনগুলো শিশুদের প্রাগ থেকে ব্রিটেন পর্যন্ত নিয়ে যেত।
শিশুদের রক্ষা করা কিন্তু সহজ কাজ ছিল না। প্রতিটি ট্রেন যাত্রাই ছিল এক ধরনের যুদ্ধ, কারণ নাৎসি বাহিনী যে কোনো মুহূর্তে এই মিশন বন্ধ করে দিতে পারত। নাৎসি সৈন্যদের চোখ এড়িয়ে শিশুদের ট্রেনে তোলা হতো। ট্রেনগুলোকে জার্মান সীমান্ত পেরিয়ে ব্রিটেনে পৌঁছাতে হতো। এই যাত্রাপথ ছিল দীর্ঘ এবং কঠিন। অনেক সময় শিশুদের পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হতো। তবে উইন্টন সবসময় নিশ্চিত করতেন, প্রতিটি শিশু সুরক্ষিতভাবে ব্রিটেনে পৌঁছে গেছে। উইন্টন এই উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন সম্পূর্ণ গোপনে।
১৯৩৯ সালের মার্চ থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত, উইন্টন এবং তার সহকর্মীরা ৮টি ট্রেনের মাধ্যমে ৬৬৯টি শিশুকে চেকোস্লোভাকিয়া থেকে যুক্তরাজ্যে নিয়ে আসেন। এই শিশুদের বেশির ভাগই ইহুদি পরিবার থেকে ছিল, যারা নাৎসি শাসনের নির্মমতার শিকার হতে পারত। আশ্চর্যের বিষয় হলো, উইন্টন নিজে এই কাজের কথা কখনো প্রচার করেননি বা স্বীকৃতি চাননি। তার কাছে এই কাজ ছিল মানবতার প্রতি তার দায়িত্বের অংশ। দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর তার এই অবদান অজানা থেকে যায়। ১৯৮৮ সালে, তার স্ত্রী গ্রেটা উইন্টন একটি পুরনো স্ক্র্যাপবুক আবিষ্কার করেন, যেখানে শিশুদের নাম, ছবি এবং উদ্ধার অভিযানের বিবরণ ছিল। গ্রেটা এই বিষয়টি জনসমক্ষে প্রকাশ করেন, এবং এরপরই উইন্টনের মহৎ কর্মের কথা সবার সামনে আসে। উইন্টন তখনও জীবিত ছিলেন। তাঁকে নিয়ে একটি টিভি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেই অনুষ্ঠানে অনেক শিশু (যারা তখন প্রাপ্তবয়স্ক) উইন্টনের সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁকে ধন্যবাদ জানায়। এটি ছিল এক আবেগঘন মুহূর্ত।
উইন্টনের মাধ্যমে রক্ষা পাওয়া শিশুরা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করে। উইন্টনের দয়া শুধু শিশুদের জীবন রক্ষা করেনি, তাদের নতুন জীবন শুরু করার সুযোগও করে দিয়েছে। এই শিশুদের অনেকেই পরে জীবনে বড় হয়ে ডাক্তার, শিক্ষক, বিজ্ঞানী এবং সমাজের জন্য অবদানকারী মানুষ হন। তাঁদের জন্য উইন্টন ছিলেন এক মহান নায়ক। তারা উইন্টনকে তাদের দ্বিতীয় পিতা হিসেবে সম্মান করে।
উইন্টন সবসময় তাদের কথা ভাবতেন, যাদের তিনি রক্ষা করতে পারেননি। যুদ্ধ শুরুর দিন একটি ট্রেন চেকোস্লোভাকিয়া থেকে ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেই ট্রেনে ২৫০টি শিশু ছিল। কিন্তু যুদ্ধের কারণে সেই ট্রেনটি আর যাত্রা করতে পারেনি। এই ঘটনা উইন্টনের জীবনে গভীর দাগ কেটে যায়। যখন তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হতো, তিনি সবসময় তার অপূর্ণতার কথা বলতেন। তিনি নিজের অর্জনের পরিবর্তে শুধু তাদের কথাই ভাবতেন, যাদের রক্ষা করতে পারেননি।
উইন্টনের এই দয়া ও সাহসিকতার গল্প বিশ্বব্যাপী অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে উঠেছে। তিনি নিজের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে অন্যদের জন্য কাজ করেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, একজন সাধারণ মানুষও দয়া, সহমর্মিতা এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তি দিয়ে পৃথিবী বদলে দিতে পারে। তার গল্প আমাদের একাধিক শিক্ষা দেয়। প্রথমত, একজন ব্যক্তি যদি সত্যিই কিছু করতে চান, তবে তিনি বড় পরিবর্তন আনতে পারেন। দ্বিতীয়ত, মানবতার জন্য কাজ করতে হলে প্রচার কিংবা নামের প্রয়োজন হয় না। উইন্টন তাঁর কাজ নিঃস্বার্থভাবে করেছেন। তৃতীয়ত, যে কোনো কঠিন পরিস্থিতিতেও যদি আমরা ধৈর্য এবং সাহস নিয়ে কাজ করি, তবে আমরা সফল হতে পারি।
উইন্টন তার কাজের জন্য ২০০৩ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছ থেকে নাইট উপাধি পান। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাধারণ জীবন-যাপন করেছেন এবং সবসময় তার অর্জনগুলোকে ‘সহজ দায়িত্ব’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ২০১৫ সালে, ১০৬ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। তবে তাঁর কাজ মানুষের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবে।
রাঁধবি তুই! কিন্তু ফেসবুকে ফটো দিয়ে আমরা ক্রেডিট নেব
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে যা পেয়েছি তা কোনোদিন ভুলব না
কীভাবে একটি ছোট্ট গ্রাম ভারতের একটি ইউটিউব রাজধানী হয়ে উঠেছে?
মানবিক রোবট : এক নতুন যুগের সূচনা
হেলথকেয়ারে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স : ভবিষ্যতের আশার আলো
জীবন থেমে থাকে না, বরং অন্যভাবে গল্প শুরু হয়
মনে হচ্ছিল আমার কোনো অঙ্গহানি হয়ে গিয়েছে
বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষন কথা বললাম
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছিল
দিনটায় আমি নিজেকে সময় দিতে পেরেছি
আপনি কোন সাহিত্যিকের কবিতা বা রচনা রোমান্টিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত মনে করেন?