চেওয়াং নোপেল : ভারতের বরফমানব


  • সজীব কুমার মন্ডল   ঢাকা, বাংলাদেশ |
  • প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৫, ১৭:৪৯
অসাধারণ সাধারণেরা
ছবি: উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি বহুল জনপ্রিয় পর্যটন স্থান হচ্ছে লাদাখ, যা ভারতের একদম উত্তর প্রান্তে অবস্থিত। প্রতিবছর বহু মানুষ সেখানে যায় তুষারের চাদরে ঢাকা পাহাড়গুলো কাছে থেকে দেখতে। বছরের বিভিন্ন সময় পর্যটকরা ভিড় করে লাদাখের বিভিন্ন রকমের বৈচিত্র্য উপভোগের জন্য। লাদাখের স্থানীয় মানুষদের জীবন জীবিকার বড় একটি অংশ পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। এর পেছনে বড় একটা কারণ হচ্ছে প্রতিকূল পরিবেশ। বছরের বড় একটা সময় আবহাওয়া এতটাই প্রতিকূলে থাকে যে দূর-দূরান্ত থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। পর্যাপ্ত পানির অভাবে স্থানীয়রা চাষাবাদ, পশুপালন ইত্যাদি কোনো ধরনের কাজ খুব সহজে করতে পারেন না । লাদাখের এসব দুঃখ-দুর্দশা আজ থেকে চার দশক আগেও খুব প্রকট ছিল। কিন্তু একজন ব্যক্তির অসীম সাহসিকতা এবং তুমুল আত্মবিশ্বাসের ফলে আজ এই সংকট কিছুটা হলেও মেটাতে পেরেছে লাদাখের মানুষজন। 

ধৈর্য, উদ্ভাবনী শক্তি এবং তুমুল আশাবাদী এই মানুষটির নাম চেওয়াং নোপেল। তাকে ভারতের আইসম্যান নামে ডাকা হয়। তো আসুন আইসম্যানকে সাথে নিয়ে সামনে এগোনো যাক।  

১৯৩৫ সালে লাদাখের বড় শহর লেহতে জন্ম নেওয়া নোপেল ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছিলেন পানির সংকট। গ্রামবাসীরা কৃষির জন্য বরফ গলিয়ে যতটুকু পানি পেত, সেটিই ছিল তাদের প্রধান ভরসা। কিন্তু প্রাকৃতিক এই বরফ গলতো খুব দেরিতে। ধরা যাক সেচের জন্য পানি দরকার আজকে কিন্তু জমে থাকা বরফ গলতে শুরু করবে আগামীকাল আর পানি পাওয়া যাবে পরশু। এর মানে গ্রামবাসীদের যখন পানির দরকার তখন পানি পাওয়া যেত না।  ফলে বীজ রোপণের সময় কৃষকরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতো। 

কৃষকরা এমন কোনো ব্যবস্থার খুঁজছিল যার মাধ্যমে জমানো পানি গরমকাল পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে এবং তারা সুবিধামতো চাষাবাদ করতে পারবে। 

চেওয়াং নোপেল কাশ্মীরে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করেন। পড়াশোনাকালীন সময় থেকেই লাদাখের কাঠামোগত এবং পরিবেশগত সমস্যাগুলো সম্পর্কে আগ্রহ ছিল তার। পরবর্তীকালে তিনি জম্মু ও কাশ্মীর পল্লী উন্নয়ন বিভাগের সাথে যুক্ত হন এবং গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ শুরু করেন। ঠিক এই সময়ে তিনি লাদাখের জলসংকট সম্পর্কে গভীরভাবে জানলেন এবং এটার যে একটা সুদূরপ্রসারী কিছু সমাধান করা উচিত তা তিনি অনুভব করতে শুরু করলেন। 

১৯৮০-এর দশকে নোপেলের মাথায় একটি চিন্তা আসে। তিনি লক্ষ করেছিলেন, একটি অর্ধগলিত পাইপ থেকে পড়ে যাওয়া পানি, আস্তে আস্তে বরফের স্তর সৃষ্টি করছিল। সেই সময় তার মনে হয়েছিল, যদি তিনি প্রাকৃতিক হিমবাহগুলোর মতো কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করতে পারেন, তবে সেই পানি  শীতকালে সংরক্ষণ করা যেতে পারে এবং তা গরমের সময় কৃষকদের সাহায্য করতে পারে। তিনি পরবর্তী সময়ে বিষয়টি নিয়ে আরো ভাবতে শুরু করলেন এবং উপলব্ধি করলেন যে  বরফটি সরাসরি সূর্যালোকের সংস্পর্শে যেখানে থাকে, সেখানে তা দ্রুত গলে যায়, কিন্তু যখন বরফটি পাথর বা ভবন দ্বারা ছায়াযুক্ত হয়, তখন তা ধীরে ধীরে গলে। এই চিন্তার মধ্য দিয়ে তিনি একটা সুন্দর সমাধানের কল্পনা করলেন যে শীতকালে ব্যবহার না করা অতিরিক্ত পানিকে যদি কৃত্রিম হিমবাহে পরিণত করা যায় তাহলে সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। 

নোপেল কীভাবে কৃত্রিম হিমবাহ নির্মাণ পরিকল্পনা শুরু করলেন তা একটু আলোচনা করা যাক।  প্রথমত পাহাড়ের বুক বেয়ে আসা পানির সংরক্ষণ করা সবচেয়ে জরুরি ছিল। সংরক্ষণ স্থান এমন জায়গায় হতে হতো যেখানে পানি শীতকালে জমে থাকবে এবং পরে গরমকালে গলে গলে তৈরিকৃত পথ হয়ে গ্রামের দিকে আসবে। সেজন্য নোপেল শীতকালে অতিরিক্ত পাহাড়ি নদীর পানিকে ছায়াযুক্ত স্থানে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা শুরু করেন। যার ফলে সেখানে জল জমে বরফের স্তরে পরিণত হবে, যা গলতে শুরু করবে গরমকালে। তিনি মূলত এই কৃত্রিম হিমবাহগুলো প্রাকৃতিক হিমবাহগুলোর তুলনায় নিম্ন উচ্চতায় তৈরি করেছিলেন, যার ফলে সেগুলো আগেই গলে যাবে এবং কৃষকদের জন্য প্রয়োজনীয় জল সরবরাহ করবে। 

প্রথম কৃত্রিম হিমবাহটি ছিল ফুৎসে গ্রামে, যেখানে নোপেল স্থানীয় জনগণের সাথে মিলিত হয়ে কাজ করেছিলেন। তারা স্থানীয় উপকরণ যেমন পাথর ও মাটি ব্যবহার করে একটি কৃত্রিম পথ বা সুড়ঙ্গ তৈরি করেন, যাতে পানি সংগ্রহের এলাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। যখন এই জল জমে বরফে পরিণত হয়, তখন তা একটি পর্দার মতো জমে থাকে, যা গরমে ধীরে ধীরে গলে যায় এবং কৃষকদের জন্য পানি  সরবরাহ নিশ্চিত করে। 

বছরের পর বছর ধরে, নোপেল আরও ১৫টি কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করেন, এমনকি কিছু কিছু কৃত্রিম হিমবাহ দুই কিলোমিটার পর্যন্ত প্রসারিত। এই হিমবাহগুলো কোটি কোটি লিটার পানি সংরক্ষণ করতে সক্ষম ছিল যা মরুভূমির মতো ভূমিকেও উর্বর জমিতে পরিণত করে। নোপেলের এই যুগান্তকারী  উদ্যোগগুলো লাদাখের কৃষিকাজকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল এবং এখনো করে যাচ্ছে। যার ফলে  লেহের মতো শহরে অভিবাসন কমে আসছে এবং গ্রামগুলোর জীবনযাত্রা উন্নত হচ্ছে। 

নোপেলের কাজের প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর। কৃষকরা যারা আগে জলসংকটে ভুগছিলেন, তারা এখন বার্লি ও গমের মতো ফসল ফলাতে সক্ষম হন। তার এই প্রচেষ্টা শুধু গ্রামবাসীদেরই নয়, বরং পুরো বিশ্বের কাছে জলসংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করারও একটি দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাথমিকভাবে, কিছু মানুষ তাকে ‘পাগল’ বলে উপহাস করেছিল, তবে নোপেলের অধ্যবসায় তাকে প্রশংসার দিকে নিয়ে যায়। ২০১৫ সালে, তিনি ভারতের অন্যতম সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মশ্রী পান। এ ছাড়াও জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে নোপেলের পানি সংরক্ষণ পদ্ধতি সারা পৃথিবীতে পরিচিতি পেয়েছিল। 

চেওয়াং নোপেল ২০২২ সালে মারা যান, কিন্তু তার উত্তরাধিকার এখনও অটুট রয়েছে এবং তা হচ্ছে আশার এবং উদ্ভাবনের একটি স্মারক। তার কৃত্রিম হিমবাহগুলো বিশ্বব্যাপী অনুরূপ প্রকল্পগুলোকে অনুপ্রাণিত করেছে, যার মধ্যে সোনাম ওয়াংচুকের উদ্ভাবিত আইস স্টুপাস উল্লেখযোগ্য। নোপেল সোনামের উন্নত প্রযুক্তির প্রশংসা করেছিলেন। তবে তিনি সবসময় তার সরল এবং সস্তা পদ্ধতিতে বিশ্বাসী ছিলেন, যা স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণের ওপর নির্ভরশীল ছিল। 

নোপেলের কাজের প্রভাব যে শুধু লাদাখেই তা কিন্তু নয়, বরং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক হিমবাহগুলো গলছে এবং তার ফলে অনেক অঞ্চলে জলসংকট তীব্র হচ্ছে। তার কৃত্রিম হিমবাহগুলো এই সংকটের মোকাবিলায় একটি টেকসই এবং কার্যকরী সমাধান হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। নোপেলের এই পদ্ধতিগুলো বিশ্বব্যাপী পানির সংকট মোকাবিলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। 

নোপেলের গল্প শুধু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দিক থেকে নয়, বরং এটি একটি জীবনের শিক্ষা—এটি প্রমাণ করে যে বয়স কোনো বাধা নয় এবং শিখতে থাকলে জীবনের যে কোনো পর্যায়ে নতুন কিছু উদ্ভাবন করা সম্ভব। আজও লাদাখের বিভিন্ন গ্রামে নোপেলের কৃত্রিম হিমবাহগুলো একটি মানবিক উদ্ভাবনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা পরিবেশগত দুর্দশার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ এবং টেকসই উন্নয়নের এক দৃষ্টান্ত। চেওয়াং নোপেলের জীবন এবং কাজ শুধু প্রকৌশলবিদদের এবং পরিবেশবিদদের নয়, বরং সবাইকে শেখায় যে, একজন মানুষের মাধ্যমে পৃথিবীতে সত্যিকার পরিবর্তন আনাও সম্ভব।


ক্যাটাগরি: অসাধারণ সাধারণেরা

         

  রেটিং: ০

এই বিভাগের আরও পোস্ট

রসিঘর

রাঁধবি তুই! কিন্তু ফেসবুকে ফটো দিয়ে আমরা ক্রেডিট নেব

  • মোঃ ইমরুল ইউসুফ|
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: রসিঘর

ক্যাম্পাস

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে যা পেয়েছি তা কোনোদিন ভুলব না

  • সজীব কুমার মন্ডল |
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: ক্যাম্পাস

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

কীভাবে একটি ছোট্ট গ্রাম ভারতের একটি ইউটিউব রাজধানী হয়ে উঠেছে?

  • খাদিজা আক্তার |
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

মানবিক রোবট : এক নতুন যুগের সূচনা

  • বর্ষা রানী দে|
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

হেলথকেয়ারে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স : ভবিষ্যতের আশার আলো

  • অর্ণব মিত্র উৎসব|
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

সর্বশেষ

সবচেয়ে পঠিত

মনে হচ্ছিল আমার কোনো অঙ্গহানি হয়ে গিয়েছে

মনে হচ্ছিল আমার কোনো অঙ্গহানি হয়ে গিয়েছে

  • সুরাইয়া সারমিন , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নাই নেট

বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষন কথা বললাম

বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষন কথা বললাম

  • উসরাত জাহান নিতু , বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
নাই নেট

দিনটায় আমি নিজেকে সময় দিতে পেরেছি

দিনটায় আমি নিজেকে সময় দিতে পেরেছি

  • আশা আক্তার জুঁই , রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
নাই নেট

আজকের জরিপ 01

আপনি কোন সাহিত্যিকের কবিতা বা রচনা রোমান্টিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত মনে করেন?