হোসে মুজিকা : এক সাধারণ মানুষের অসাধারণ দর্শন


  • এহতাছুন আফরিন ইভা   ঢাকা, বাংলাদেশ |
  • প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৫, ১৫:৩১
অসাধারণ সাধারণেরা
ছবি : গুগল থেকে নেওয়া।

জোসে ‘পেপে’ মুজিকা—একজন নেতা, দার্শনিক, এবং মানবতার এক অনন্য ফেরিওয়ালা। তিনি ‘বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তিনি কখনো নিজেকে দরিদ্র ভাবেননি। তাঁর মতে, প্রকৃত দরিদ্র তারা, যারা সীমাহীন চাহিদার পিছনে ছুটতে ছুটতে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়। 

জোসে মুজিকার জন্ম ১৯৩৫ সালের ২০ মে, উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিওর উপকণ্ঠে। তার পরিবার ছিল খুবই সাধারণ ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত। তার বাবা কৃষিকাজ করতেন। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে তিনি ঋণে জর্জরিত হয়ে মারা যান যখন মুজিকা মাত্র সাত বছর বয়সী। এ কারণে শৈশবেই তাকে কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়।

তরুণ বয়সে মুজিকা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৬০-এর দশকে উরুগুয়ের তুপামারোস (Tupamaros) নামের একটি বামপন্থি গেরিলা আন্দোলনে যোগ দেন। এই দলটি সামাজিক সাম্য ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করছিল। 

সরকারবিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত থাকার কারণে মুজিকা বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হন এবং কারাগারে কঠোর নির্যাতনের শিকার হন। তিনি মোট ১৪ বছর কারাবন্দি ছিলেন। তিনি প্রায় এক দশক একাকী নির্জন কারাবাসে কাটান। সেই কঠিন সময়েও তিনি হার মানেননি বরং আত্মশক্তি ও ধৈর্যের পরিচয় দেন।

১৯৮৫ সালে উরুগুয়ের সামরিক শাসনের অবসান হলে মুজিকা মুক্তি পান। এরপর তিনি মূলধারার রাজনীতিতে যোগ দেন এবং ১৯৯৪ সালে পার্লামেন্ট সদস্য হন। ধাপে ধাপে জনপ্রিয়তা অর্জন করে তিনি ২০০৯ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২০১০ সালে উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হন।

২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মুজিকা। কিন্তু ক্ষমতার সঙ্গে আসা বিলাসবহুল জীবন তিনি গ্রহণ করেননি। রাষ্ট্রপতি প্রাসাদ ছেড়ে তিনি থাকতেন স্ত্রীসহ একটি ছোট্ট ফার্মহাউসে। যেখানে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে মাটির সাথে মিশে সবজি চাষ করতেন। রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও তার জন্য কোনো দামি গাড়ি বা দেহরক্ষীর বাহার ছিল না। এমনকি নিজের বেতনের ৯০% তিনি দান করে দিতেন দরিদ্রদের সহায়তায়।

ক্ষমতা নয়, মানুষের কল্যাণই ছিল লক্ষ্য ছিল মুজিকার। একবার জার্মান সফরে গিয়ে তিনি দেখলেন তার নিরাপত্তার জন্য সামনে-পেছনে প্রায় ৮০টি মোটরসাইকেল চলছে। এত আড়ম্বর দেখে তিনি বিব্রত হলেন। তার কাছে এসব বিলাসিতা অর্থহীন মনে হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, প্রেসিডেন্টের বিশাল প্রাসাদ থাকার কোনো দরকার নেই, বরং সেটিকে একটি স্কুলে পরিণত করাই বেশি যুক্তিসঙ্গত।

তার দর্শন ছিল সহজ। সুখ মানে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কিছু না চাওয়া। তিনি মনে করতেন একজন মানুষ তখনই মুক্ত হতে পারে যখন সে চাহিদা থেকে নিজেকে মুক্তি দেয়। মানুষের উচিত তার চাহিদা কমিয়ে জীবনকে সহজ করা। তিনি মনে করতেন, আধুনিক সমাজ মানুষের ওপর অহেতুক চাপ সৃষ্টি করে। বর্তমান পুঁজিবাদ এবং বাজারব্যবস্থা আমাদের শিখিয়েছে যে যত বেশি ভোগ, তত বেশি সুখ। কিন্তু বাস্তবে এর উল্টোটা সত্য।

তার দর্শন অনুযায়ী, জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য কাজের ভার কমিয়ে নিজেকে ও নিজের সময়কে গুরুত্ব দেওয়া। মানুষের উচিত এমন একটি লক্ষ্য খুঁজে নেওয়া যা তার জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। অন্যথায় মানুষ বাজার অর্থনীতির দাসে পরিণত হয়। অবিরাম কাজ করে শুধু অমূলক চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে। তিনি মনে করতেন, নিজের অন্তরের সঙ্গে কথা বলা খুব জরুরি। কারণ শেষ পর্যন্ত ভালো বা খারাপ সময়ে আমাদের একমাত্র সঙ্গী আমরা নিজেই। তবুও তিনি মানুষের প্রতি আস্থা রাখতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রকৃত সুখ খুবই সাধারণ কিছু, যা জটিলতা থেকে মুক্ত।

মুজিকা বিশ্বাস করতেন, প্রযুক্তি মানুষের জন্য হলেও আমরা একে এমনভাবে ব্যবহার করছি যে এটি আমাদের মানবিক সম্পর্কগুলো নষ্ট করে দিচ্ছে। তিনি বলতেন, “মানুষ শুধু শব্দ দিয়ে কথা বলে না, চোখের ভাষা, অঙ্গভঙ্গি, নীরবতাও অনেক কিছু প্রকাশ করে।” তাই সামনাসামনি কথা বলার গুরুত্ব কখনোই ডিজিটাল প্রযুক্তি পুরোপুরি মুছে দিতে পারবে না। মানুষ আবেগপ্রবণ প্রাণী যারা কেবল যুক্তি দিয়ে নয় অন্তরের অনুভূতি দিয়েও সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এসব বিষয়ে আমরা এখনো পুরোপুরি সচেতন নই।

মুজিকা প্রকৃতিকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। এমনকি ছোট্ট পিপীলিকার গল্পও তাকে ভাবনায় ফেলত। তিনি বিশ্বাস করতেন, পরিবেশ রক্ষা শুধু আমাদের প্রয়োজন নয় বরং দায়িত্ব। তাই তিনি সবসময় প্রকৃতি সংরক্ষণের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দিয়ে গেছেন।

মুজিকার ধর্ম নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত সম্মানজনক এবং যুক্তিবাদী। তিনি জানতেন, পৃথিবীর প্রায় ৬০% মানুষ কোনো না কোনো ধর্মে বা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাস তাদের জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলোতে বেঁচে থাকার শক্তি দেয়। তাই তিনি সব ধর্মের প্রতি সম্মান দেখাতেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি কোনো ধর্ম বা ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন না। তার মতে, জন্মের মুহূর্ত থেকেই জীবনের সবচেয়ে বড় রহস্যের সৃষ্টি হয়—আমরা সবাই একদিন মৃত্যু বরণ করব অথচ এই রহস্যের সঠিক উত্তর আমাদের জানা নেই।

মানবজাতি নিয়েও তিনি গভীরভাবে চিন্তিত ছিলেন। কিছু মানুষ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উইন্ড মিল বানাচ্ছে। অন্যদিকে কেউ পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে ধ্বংসের জন্য। মানুষ একই সাথে বুদ্ধিমান আবার আত্মবিধ্বংসী। একবার তিনি বলেছিলেন, “আমি যত বেশি মানুষকে জানছি, ততই পশু-পাখিদের প্রতি আমার ভালোবাসা বাড়ছে।” তার এই মন্তব্যের মধ্যে মানবসভ্যতার বর্তমান অবস্থা ও আমাদের অমানবিক হয়ে যাওয়ার গভীর সংকেত লুকিয়ে আছে।

মুজিকার লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষের কল্যাণ এবং সুখকে সহজলভ্য করা। তিনি বিশ্বাস করতেন, জীবন যতই কঠিন হোক না কেন একে ভালোবাসতে হবে। এমনকি ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পরও তিনি তার জীবনবোধে অটল ছিলেন।

জোসে মুজিকার জীবন আমাদের শেখায়—সুখ মানে বিলাসিতা নয় বরং প্রয়োজনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারাই প্রকৃত সুখ। আধুনিক সমাজ আমাদের ভোগবাদী হতে শেখাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত শান্তি আসে সংযমের মধ্য দিয়ে।

তিনি এক সাধারণ জীবন যাপন করেও প্রমাণ করে গেছেন যে, একজন মানুষের বড় হওয়ার জন্য প্রচুর সম্পদ বা ক্ষমতার প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন শুধু সৎ উদ্দেশ্য, সংযম ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা।


ক্যাটাগরি: অসাধারণ সাধারণেরা

         

  রেটিং: ০

এই বিভাগের আরও পোস্ট

রসিঘর

রাঁধবি তুই! কিন্তু ফেসবুকে ফটো দিয়ে আমরা ক্রেডিট নেব

  • মোঃ ইমরুল ইউসুফ|
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: রসিঘর

ক্যাম্পাস

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে যা পেয়েছি তা কোনোদিন ভুলব না

  • সজীব কুমার মন্ডল |
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: ক্যাম্পাস

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

কীভাবে একটি ছোট্ট গ্রাম ভারতের একটি ইউটিউব রাজধানী হয়ে উঠেছে?

  • খাদিজা আক্তার |
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

মানবিক রোবট : এক নতুন যুগের সূচনা

  • বর্ষা রানী দে|
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

হেলথকেয়ারে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স : ভবিষ্যতের আশার আলো

  • অর্ণব মিত্র উৎসব|
  •  ২৩-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

সর্বশেষ

সবচেয়ে পঠিত

মনে হচ্ছিল আমার কোনো অঙ্গহানি হয়ে গিয়েছে

মনে হচ্ছিল আমার কোনো অঙ্গহানি হয়ে গিয়েছে

  • সুরাইয়া সারমিন , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নাই নেট

বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষন কথা বললাম

বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষন কথা বললাম

  • উসরাত জাহান নিতু , বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
নাই নেট

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছিল

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছিল

  • ইমরান চৌধুরী , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নাই নেট

দিনটায় আমি নিজেকে সময় দিতে পেরেছি

দিনটায় আমি নিজেকে সময় দিতে পেরেছি

  • আশা আক্তার জুঁই , রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
নাই নেট

আজকের জরিপ 01

আপনি কোন সাহিত্যিকের কবিতা বা রচনা রোমান্টিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত মনে করেন?