ক্যাম্পাস

শেষ বেঞ্চ থেকে প্রথম সারি


  • বিজয়া সরকার   বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় |
  • প্রকাশ : ২১ জুন ২০২৫, ২৩:৩৫
ক্যাম্পাস
ফোটোঃ উপমা দত্ত

২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের এক কুয়াশাঘেরা হিম সকালে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে শুরু হয় আমার শিক্ষা জীবনের নতুন অধ্যায়। শৈশব হতে কেন যেন সমাজবিজ্ঞান বিষয়টি আমার দুরূহ মনে হতো। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক, দুটোই আমি ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে করেছি, তাই সমাজবিজ্ঞান আমার কাছে খুব বেশি পরিচিত ছিল না, সেই আমিই কিনা হয়ে গেলাম সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী।

প্রথম দিন ক্লাসে গিয়ে দেখি, সবাই অনেক আত্মবিশ্বাসী, যেন সবাই অনেক জানে; শুধু আমিই যেন কিছু না জানার দলে। তাই আমি ক্লাসের শেষ বেঞ্চে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম। কেউ আমার দিকে তাকাত না, কথাও বলত না। আমি শিক্ষকদের কথা মন দিয়ে শুনতাম, কিন্তু কিছুই বুঝতাম না। শিক্ষকদের প্রশ্নের উত্তরে যারা নির্ভুলভাবে সাড়া দিত তাদের দিকে তাকিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগত যে আমিও কি কখনো পারব! 

এক রকম অস্থিরতার মধ্যেই কেটে গেল আমার প্রথম সেমিস্টার। পরীক্ষা দিলাম, নিজের মাঝে লুকিয়ে থাকা সেরা হওয়ার ইচ্ছেটা তখনও অদৃশ্য ছিল। তবে সময়ের সাথে সাথে আমার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিলেন কয়েকজন শিক্ষক। 

আশিকুজ্জামান স্যার প্রথম আমাকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে পড়ালেখাতে ভালো করা যায়। তাঁর দিকনির্দেশনায় প্রথমবারের মতো আমি নিজের মধ্যে উৎসাহ খুঁজে পাই। ইশরাত জাহান আইমুন ম্যাম ছিলেন আমার স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি আমাকে বলতেন যে চাইলে আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারব। তাঁর এই কথাটি আমার হৃদয়ে গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিল। ওয়াহিদুজ্জামান (পিন্টু) স্যারের হাত ধরে আমি সমাজবিজ্ঞানকে নতুন করে চিনতে শিখি, তাঁর পাঠদান আমাকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়। 

নাহিদা সুলতানা ম্যাম সবসময়ই একজন বড় বোন হয়ে আমার পাশে ছিলেন। তারেক মাহমুদ আবীর স্যার কাছে শিখি কীভাবে সমাজের নেতিবাচক দিকগুলোকে পাশ কাটিয়ে ইতিবাচকতাকে আঁকড়ে ধরা যায়। সাদমান সাকিব বিন রহমান স্যার আমাদের প্রিয় শিক্ষক ছিলেন, তাঁর কঠিন বিষয়বস্তু সহজভাবে বোঝানোর দক্ষতা সত্যিই অনন্য। 

আমার শিক্ষকদের উৎসাহ আর ভালোবাসায় আমার ভেতরের সংশয়গুলো কাটতে শুরু করে। সমাজবিজ্ঞানকে নিয়ে আমার ভয় কেটে যায়, প্রতিদিন নতুন কিছু জানার আগ্রহ আমাকে ক্লাসরুমে চুম্বকের মতন টেনে নিয়ে যেত। 

এরপর আশিক এলাহি স্যার এবং সাদেকুর রহমান স্যারের নিকটে শিখি কীভাবে নিজেকে আরও উন্নত করার পথে এগিয়ে নেওয়া যার। সুমি রানী সাহা ম্যাম, দিল আফরোজ তানিয়া ম্যাম, ও ফারজানা আফরোজ ম্যামের কাছ থেকে শুনেছি মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার গল্প—যে গল্প আমাকে জুগিয়েছে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য সাহস।


আমার প্রিয় শিক্ষক অসীম কুমার নন্দী স্যার যার সান্নিধ্য ছাড়া হয়তো আমি আজকের আমি হতে পারতাম না। তার দিকনির্দেশনায় গবেষণায় আমার হাতেখড়ি হয়। প্রতিটি গবেষণার ধাপ তিনি এমন যত্নের সাথে শিখিয়েছেন যে তা আমি কোনোদিনও ভুলব না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিকে আমার তেমন বন্ধু-বান্ধব না থাকলেও সময়ের সাথে সাথে বেশ কিছু ভালো বন্ধু পেয়েছি। তারা শুধু বন্ধু ছিল না, আমার জীবনের প্রতিটি খুশির, দুঃখের মুহূর্তে পাশে থাকা একেকজন সহযোদ্ধা। এমন কিছু বন্ধুও পেয়েছি যারা আমার সফলতায় আমার থেকেও বেশি খুশি হতো, যা আমার কাছে এক অসাধারণ অনুভূতি। ধীরে ধীরে সবাই আমরা এক পরিবার হয়ে উঠলাম। এই বন্ধুরা শুধু মজার মুহূর্তই উপহার দেয়নি, আমার জীবনের কঠিন সময়ে পাশে থেকে সাহস দিয়েছে।

আমার জীবনের আরেকটা পরিবার পেয়েছিলাম আমার রুমমেট ও ফ্ল্যাটমেটদের মধ্যে। পরিবার থেকে দূরে এসে যেন আরেকটি পরিবারের সন্ধান পেয়েছিলাম। সেখানে সিনিয়র-জুনিয়রের ভেদাভেদ ছিল না, সবাই মিলে একসাথে পড়াশোনা, রান্না করা, গল্প করা—সবকিছুতেই আমাদের এক অদ্ভুত আন্তরিকতা ছিল। আমার পড়ালেখার ব্যাপারে এই পরিবারের সদস্যরাও আমাকে উৎসাহ দিত, সাহায্য করত। ক্লাসের বাইরে আমাদের এই বন্ধনগুলো আমাকে সাহসী ও দৃঢ় করেছে।

আজ আমার সেই শিক্ষকদের কাছ থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণা এবং বন্ধুদের ভালোবাসা আমাকে আমার স্বপ্নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমার এই গল্প শুধু আমার নয়, বরং প্রতিটি শিক্ষার্থীর সংগ্রাম, আশা, এবং অর্জনের গল্প।

আজ আমি, যে মেয়েটি একসময় ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসে নিজেকে নিয়ে হতাশ হতো, সে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। আমার এই গল্প শুধু আমার নয়, প্রতিটি শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনের সংগ্রামের গল্প। শিক্ষকদের আন্তরিক সহযোগিতায় আজ আমার মনে সাহস, আত্মবিশ্বাস আর অনুপ্রেরণার আলো জ্বলছে। এভাবেই বেঁচে থাকুক ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, এগিয়ে যাক আমাদের শিক্ষাজীবন।



ক্যাটাগরি: ক্যাম্পাস

         

  রেটিং: ০

এই বিভাগের আরও পোস্ট

ক্যাম্পাস

১৯০ বছরের চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল

  • পার্থিব মাহমুদ |
  •  ২৭-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: ক্যাম্পাস

সাময়িকী

আনন্দের রঙিন রাতগুলো : ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবল

  • কানিজ সাবাতিনা |
  •  ২৭-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: সাময়িকী

অসাধারণ সাধারণেরা

একটি ছোট্ট গ্রাম ভারতের ইউটিউব রাজধানী হয়ে উঠেছে

  • খাদিজা আক্তার |
  •  ২৭-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: অসাধারণ সাধারণেরা

সাময়িকী

প্রযুক্তির উন্নয়নে গ্রাম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পড়ালেখা

  • ইন্দ্রজিৎ বিশ্বাস |
  •  ২৭-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: সাময়িকী

সাক্ষাৎকার

শাড়ি নিয়ে শিল্পীতে-অনুরাগীতে আলাপ

  • মো. রায়হান ও মাকসুদ খান সোহান |
  •  ২৭-০৬-২০২৫
ক্যাটাগরি: সাক্ষাৎকার

সর্বশেষ

১৯০ বছরের চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল

১৯০ বছরের চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল

  • পার্থিব মাহমুদ  ঢাকা
ক্যাটাগরি: ক্যাম্পাস

আনন্দের রঙিন রাতগুলো : ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবল

আনন্দের রঙিন রাতগুলো : ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবল

  • কানিজ সাবাতিনা  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ক্যাটাগরি: সাময়িকী

একটি ছোট্ট গ্রাম ভারতের ইউটিউব রাজধানী হয়ে উঠেছে
প্রযুক্তির উন্নয়নে গ্রাম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পড়ালেখা

প্রযুক্তির উন্নয়নে গ্রাম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পড়ালেখা

  • ইন্দ্রজিৎ বিশ্বাস  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ক্যাটাগরি: সাময়িকী

শাড়ি নিয়ে শিল্পীতে-অনুরাগীতে আলাপ

শাড়ি নিয়ে শিল্পীতে-অনুরাগীতে আলাপ

  • মো. রায়হান ও মাকসুদ খান সোহান  সিরাজগঞ্জ ও ঢাকা
ক্যাটাগরি: সাক্ষাৎকার

সবচেয়ে পঠিত

মনে হচ্ছিল আমার কোনো অঙ্গহানি হয়ে গিয়েছে

মনে হচ্ছিল আমার কোনো অঙ্গহানি হয়ে গিয়েছে

  • সুরাইয়া সারমিন , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নাই নেট

বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষন কথা বললাম

বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষন কথা বললাম

  • উসরাত জাহান নিতু , বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
নাই নেট

দিনটায় আমি নিজেকে সময় দিতে পেরেছি

দিনটায় আমি নিজেকে সময় দিতে পেরেছি

  • আশা আক্তার জুঁই , রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
নাই নেট